আজিজাঃস্যাডিজমের শিকার -
এইচ বি রিতা
Published on: নভেম্বর 6, 2017
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এটাই সত্য। তবে সেই সেরা ঠিক কোন অর্থে, তা বোধকরি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিবেচনার বিষয়। মানুষই একমাত্র জীব যে কিনা কাঁচা গোস্ত সিদ্ধ করে খাওয়া শিখেছে। মানুষই সেই জীব যে নগ্নতা থেকে সভ্য হতে কাপরের ব্যবহার শিখেছে। মানুষই সেই জীব, যে সর্ববিষয়ে সেরা হতে সভ্যতাকে পিছু হটিয়ে অসভ্যতাকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। মানুষ সত্যিই সৃষ্টির সেরা জীব। নিজের বিশেষত্বকে প্রমান করতে মানুষ কি না করেছে? মঙ্গলগ্রহ- চাদ ভ্রমন থেকে শুরু করে বেশ্যাপল্লী পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে মানুষ তার বিশেষত্ব বজায় রেখেছে। অবশেষে, নৃসংশতায়ও মানুষ নিজের বিশেষত্ব প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে।
শিবপুরের খৈনকুট গ্রামের কিশোরী আজিজা বেগমকে।বয়স ১৪। প্রেমিকের সঙ্গে চাচী বিউটি বেগমের অনৈতিক পরকীয়ার কার্যকলাপ দেখে ফেলায় পরিকল্পিতভাবে মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে, বিউটি বেগম রুবেল নামক একজনের সহায়তায় আজিজার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। মৃত্যুর আগে আজিজা ঘটনার বর্ণনা করে যায়।
নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতায় গোটা বাংলাদেশ আজ প্রশ্নবিদ্ধ। একের পর এক শিশু নির্যাতন, শিশুহত্যা, শিশু ধর্ষন- এই প্রমান করে যে বাংলাদেশ আজ পাশবিকতা নামক সামাজিক ব্যাধীতে আক্রান্ত। প্রতিদিন কোন না কোন পাশবিকতা নতুন করে গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে প্রশ্নের সন্মূখীন করছে। পায়ূপথে বাতাস ঢুকিয়ে শিশুকে হত্যা, গাছে বেঁধে শিশুকে হত্যা, ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে শিশুকে হত্যা, ধর্ষণ করে শিশুকে হত্যা, এসবই বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা ও স্যাডিষ্ট চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
স্যাডিজমের বিস্তর উদাহরণ রয়েছে পৃথিবীতে। সতীদাহ প্রথাকে যারা কৌলিন্যবাদের অংশ ভাবতেন তারা স্যাডিস্ট। কন্যাসন্তান জন্মদানের অপরাধে যারা অত্যাচার চালান নারীর ওপর, তারা স্যাডিস্ট। প্রেম প্রত্যাখ্যাত এসিডবাজ স্যাডিস্ট, ধর্ষন শেষে যোনীতে কাঁচের গুড়ো ঢুকিয়ে দেয়া ব্যক্তি স্যাডিষ্ট, পায়ূপথে ও গাছে বেঁধে, কিংবা গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে যারা আনন্দ পান, তারা স্যাডিষ্ট। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে যারা সাফাই গায়, তারা স্যাডিস্ট। যারা দেশের সর্বময় ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রতিদিন খুন, ধর্ষণ, অনাচার দেখেও অপরাধ দমনে সক্রীয় ভূমিকা পালন করছেন না, তারাও স্যাডিষ্ট। বাংলাদেশের সমাজের একাংশ আজ স্যাডিজমে ডুবে আছে। কারে মাঝে বিন্দুমাত্র মানবিকবোধ নেই। ব্যক্তি-সমষ্টি সব, স্বার্থপরতা, হঠকারী, নিষ্ঠুরতা, আত্মকেন্দ্রিকতায় নিমজ্জ্বিত। ব্যক্তি-সমাজ ও রাষ্ট্র মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ। আমরা যেন ক্রমেই নৈতিকতা হতে দূরে সরে যাচ্ছি। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, প্রশাসন ও সরকার যদি রুখে না দাঁড়ায়, তাহলে গোটা সমাজ ব্যবস্থা আদিযুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়ে যাবে।
সমাজের এই ব্যাধী হতে মুক্তির দ্বায়ভার কেবল ব্যক্তিবিশেষের নয়, বরং সমষ্টিগত দিক থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও। যারা দেশ শাসনের নামে প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষায় দায়বদ্ধ, যতদিন তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি না হবে, যতদিন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের কাঠামো পোক্ত না হবে, ততদিন কোন অপরাধেরই সুবিচার হবেনা।
পৃথিবীখ্যাত মার্কিন স্থপতি লুই ইসাডোর কান বলেছিলেন, “আমি যখন একটা শহরের পরিকল্পনা করি তখন লক্ষ্য থাকে এটি হবে এমন একটি শহর যার পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে একজন তরুণ তার জীবনের লক্ষ্য এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা সাজিয়ে নিতে পারবে।” আফসোস! যারা দেশ গঠনের দায়ীত্বে আছেন, তারা যদি এমন দেশ গঠনের পরিকল্পনার কথা ভাবতেন, তাহলে পদ্মা সেতুর ওপাড়ে হংকং সিটি স্থাপনের চিন্তা বাদ দিয়ে তারা “শান্তি নগর” স্থাপনের কথা ভাবতেন যেখানে স্যাডিজম চেতনার কোন স্থান থাকতনা; যেখানে স্যাডিষ্টদের নির্মম পাশবিকতায় আজিজাকে অকালে প্রাণ হারাতে হতোনা।

Add to favorites
646 views