আমি আশা বলছি -
এইচ বি রিতা
Published on: মার্চ 2, 2018
মা,
এখনো জেগে আছো? ঘুম আসছেনা বুঝি?
আচ্ছা থাক! আজ ঘুমিয়ে না! এসো, আজ আমারা কথা বলি…
মা শোন! সালমা চাচীকে জানিয়ে দাও, কাল তুমি কাজে যাবেনা। বলো, আকাশের বুকে আজ কালো রক্ত মেঘ! আজ রাতভর আকাশের বুক ফুঁড়ে রক্তবৃষ্টি ঝড়বে। সে বৃষ্টিতে ভিজে তুমি-আমি একাকার হবো! বলে দাও তাকে, কাল তুমি বিশ্রাম নিবে।
মা, তোমার ছেলেরা বুঝি একদমই দেখেনা তোমায়? ওদের কি দোষ দেবে বল! যে চারাগাছে মমতার সার মিশিয়ে এক মগ পানি ঢালেনি কেউ কখনো, সে চারাগাছ কি বেড়ে উঠলেই সুগন্ধি ফুল দেয়?
মা, মনে আছে তোমার? যেদিন স্পিরিট খেয়ে বাবা মরে গেল, শোকাহত তোমার পাশে আমাদের কচি অবুঝ মুখগুলো যেন শেষ বিকেলের ট্রেইন ছুঁটে যাওয়া কোন বেকার যুবকের হতাশায় মাখা পড়ন্ত বিকেলটি ছিল!
বুজতেই পারিনি সেদিন, ট্রেইনটি আসলেই ছুঁটে গিয়েছিল।
মা, জানো! যখন তুমি পেটের দায়ে নিজ আত্বীয়ের বাড়ী জুটা থালা বাসন মাজতে, তখনো তাদের সাথে আমাদের পরিচয় জুড়ে ছিল। কিন্তু সে পরিচয়ে আত্বীয়তা ছিলনা, ছিল চাকর আর মনিবের!
মা, ওরা যখন আমাদের পুরণো কাপর ছুঁড়ে দিত, তখন দেখেছি পাশের ঘরে কাকীমা আর তাদের মেয়েদের পরনে নতুন জামা! কতদিন ওদের দেখেছি আমাদের পাশ কাটিয়ে কাকীমার ঘরে মুড়ি চানাচুর মেখে খায়! আমরা তখন তোমার আঁচল ধরে তাকিয়ে ঢোক গিলি। আহ! জীবনও কখনো কখনো বড় অসহায় হয়ে পড়ে, তাই না মা?
মা, মাগো! তুমি জান, ওরা আমায় ধিক্কার দিত! বলতো আমি নষ্টা! কিভাবে যে নষ্ট হলাম, কেন যে নষ্ট হলাম, তা কি তুমি জাননা? ঈশ্বর দেখেননি সে অসহায়ত্ব? ওরা বুঝেনি সে ব্যাথা?
হলাম নষ্টা! দুঃখ নেই। তবে যারা দামী পোষাকে শখ করে নষ্টামীতে মাতে, তারা কে? তাদের গায়ে তো কেউ সংবিধীবদ্ধ সতর্কাকরণ পোষ্টার এঁটে দেয়না? তবে কি নষ্টামীও ধনী-গরীবের ব্যবধান বোঝে?
মা! কি বলি তোমায়! বুক খুঁড়ে বুকের ব্যাথা খুঁজতে গেলেই দেখি নোনাজলে কষ্ট কাদায় মাখামাখি! সেখানে কেবল পা পিছলে যায়!
একদিন যে নষ্ট মেয়েটি রাতভর তার নষ্টামীতে মা, ভাইদের অন্নের যোগান দিত, সে মেয়েটির নষ্টামী ঢাকতে সেদিন তারা কেউ পাশে দাঁড়ায়নি! সেদিন তারা নিজেদের শুদ্ধ রাখতে মেয়েটিকে ভুল গর্ভপাতে হসপিটালের বারান্দায় ফেলে এসেছিল!
বলতে পারো মা, কেন এমনটা করেছিলে সেদিন? বাঁচিয়ে রাখার দ্বায় যদি নিতে পারি, বাঁচিয়ে দেয়ার দ্বায়ভার কি তোমাদের ছিলনা? এভাবে কেউ ফেলে দেয় বুঝি!
মা! মাগো! অভিযোগ করছিনা। শুধু বলি, যেতে যেতে সেদিন মনে হয়েছিল, স্বচ্ছ আকাশে উড়ে যাওয়া দুধরঙ্গা বকের সারি দেখা হয়নি কোনদিন।
দেখা হয়নি সবুজ অরণ্য, বাতাসে লেবু ফুলের ঘ্রাণ, ছুঁয়ে দেখা হয়নি বরফকুচি জল; যেখানে শীতল পেলবতায় জীবন ছুঁয়ে যায় মমতার আঁচল।
অতপর, কীটপতঙ্গ পচে যাওয়া আঁশটে দুর্গন্ধ বুকে পুষে চলে এলাম সেদিন; উর্ভর নীল আকাশে সুগন্ধি বাতাস ছেড়ে, জলজ সংসারের বেহুদা মায়া ছেড়ে, একেবারেই চলে এলাম। মনে হল, মরে গিয়ে বেঁচে যাই!
মা! মাগো! ও মা! আর কেঁদোনা! কেঁদে কেঁদে কেমন হাঁপিয়ে উঠেছে। এবার ঘুমাও তুমি। চাচীকে বলে দাও… তোমার বুকে বড্ড ব্যথা! কাল তুমি বিশ্রাম নিবে।
আজ আমি যাই। ভিতরে সমাধীত আত্মাটি জেগে উঠলেই আবার চলে আসবো। রাতভর তোমাকে কাঁদাবো।
এখন তুমি ঘুমোও।

Add to favorites
1,140 views