আমি নসিমনঃ ০৩.অধীকার -
এইচ বি রিতা
Published on: সেপ্টেম্বর 10, 2017
স্বামীর ঘর ছেড়ে যখন মেয়েটাকে নিয়ে চলে আসি, তখন সর্বপ্রথম আমার মা বলেছিলেন, জামাই যখন আরেকটা বিয়ে করেই ফেলেছে তখন কি আর করা! পুরুষ মানুষই এমন! এক নারীতে মন ভরেনা রে মা। আমি কি কম সয়েছি? কিন্তু তোর বাবাকে ফেলে চলে তো যেতে পারিনি। তোদের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিতে হয়েছে।
তারপর বড় ভাই বললেন, সন্তানের দিকে তাকিয়ে মেয়েদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়।
চলে আসার সময় শাশুড়ী বললেন, যেই ভাব দেখাচ্ছিস রে মেয়ে, মনে হয় যেন তোর খানদানে কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করেনি!
এই ছিল আমার আপনজনদের স্বামীকে ছেড়ে চলে আসার প্রতিক্রীয়া।
হ্যা! মনে পড়ে, আমার যখন বয়স ৯, তখন আমার বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। আমার মা ছিলেন খুবই রুপবতী-গুনবতী একজন নারী। স্বামী আনুগত্য একজন নারী। তাকে ফেলে বাবার দ্বিতীয় বিয়ে করার কোন কারণ ছিলনা। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর মা যখন কাঁদতেন, তখন আমার দাদা বলতেন, করেই যখন ফেলেছে তখন কান্নাকাটি করে কি হবে? ইসলামে চার বিয়ে জায়েজ আছে। দাদার কথা শুনে মাকে দেখতাম চুপ করে আঁচলে চোখ মুছতেন।
আমাদের বাড়ীতে মাদ্রাসার এক হুজুর আসতেন আমাকে ও বড় ভাইকে আরবী পড়াতে। একদিন হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর! সব বাবারাই কি চার বিয়ে করতে পারে? আল্লাহ্ নাকি বলেছেন তারা চার বিয়ে করতে পারবে? তিনি এমন অন্যায় কথা কেন বললেন? হুজুর তখন অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আল-আমীন অত্যন্ত বিচক্ষন। তিনি কখনো অন্যায় কথা বলেননা। ইসলামে তিনি পুরুষকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে চার বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছেন। মন চাইলেই চার বিয়ে করা যাবেনা। তুমি এখনো ছোট। তুমি বিশ্লেষণ করলেও বুঝবেনা।
আমি তখন মনে মনে আল্লাহর প্রতি রাগান্বিত হতাম। সৎ মাকে বাবা আলাদা বাড়ীতে রাখতেন। যতবার বাবা মাকে ছেড়ে সৎ মায়ের বাড়ীতে যেতেন, মা রাতভর কাঁদতেন। আর তখনই আল্লাহ্ কে অভিযোগ করতাম। বাবাকে এমন অনুমতি দেয়ায় আল্লাহ্ কে মনে মনে খুব করে বকে দিতাম। কখনো দুঃখ না বুঝেই মায়ের আঁচল ধরে কাঁদতাম। যখন সৎ মায়ের ঘরে ফুটফুটা কন্যা সন্তান এল আর বাবা তাকে কোলে তুলে আমাদের বাড়ী নিয়ে এল, তখন দুঃখটা খুব বেশী বেড়ে গেল। তখন শুধু মনে হত, বাবা বুঝি ভাগ হয়ে গেল!
যা বলছিলাম! আমার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে। তারও বিয়ে করার কোন কারণ ছিলনা। তবু করল, তারই অফিসের এক সুন্দরী কলিগকে। কলিগ অবিবাহিতা! প্রণয়ের জের ধরে কলিগ গর্ভবতী হয়ে পড়লে চট জলদি তারা বিয়ে করে ফেলে। আমাকে সে বিয়ে মেনে নিতে বলে। আমি মানতে পারিনি! যে স্বামী আমাকে রেখে অন্য নারীকে ভালবেসে গর্ভবতী করে, সে স্বামী তো আমাকে ভালই বাসেনি কখনো! তার সাথে এক বিছানায় যাই কি করে!
আমার মা মেনে নিয়েছিলেন বলে আমাকেও মেনে নিতে হবে কেন? আমার বাবা অন্যায় করেছিলেন বলে আমার স্বামীকেও করতে হবে কেন? ইসলামের নিয়মানুসারে তারা কি দ্বিতীয় বিয়ে করার আগে আমাদের অনুমতি নিয়েছিলেন? আমরা কি বন্ধ্যা ছিলাম? স্বামী সঙ্গমে অক্ষম ছিলাম? স্বামী বলেই তাদের অন্যায় খায়েশ মেনে নিতে হবে কেন?
আমার মায়ের সাহস ছিলনা প্রশ্ন করার। আমার সাহস আছে। আর আছে বলেই আমি মেনে নেইনি।
মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে! মাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, মা! যে মানুষটাকে তার প্রিয় খাবার রেঁধে পাশে বসে খাওয়ালে, আঁচলে ঘাম মুছে দিলে, যে মানুষটার বুকে জড়িয়ে শুধু তুমিই ঘুমালে, সে মানুষটার বুকে অন্য নারীকে যেতে দেখে তোমার ভিতরটায় কেমন করেছিল বলতো? এই যে মানুষটা তোমার ভালবাসার কদর করলনা, তোমার আত্মত্যাগের সন্মান করলনা, তারপরও তোমার কষ্ট হয়নি মানুষটার পাশে ঘুমাতে?
হয়তো মায়ের কষ্ট হয়েছে অনেক। সয়ে গেছেন। ভালবেসে প্রতারিত হওয়ার কষ্ট তারও ছিল। ভালবেসে বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণা তারও ছিল। আমার মত হয়তো অভিমানী ছিলেন না তিনি। কিংবা মধ্যরাতে অভিমানের গলা টিপে মুখে কাপর গুঁজে দিতেন যেন তার চিৎকার কেউ না শুনেন।
কিংবা হয়তো মা বাবাকে খুব বেশী ভালবাসতেন না। ভালবাসার সংজ্ঞাই হয়তো জানতেন না তিনি। ভালবাসার মানুষকে যেতে দেয়া যায় কি? ভাগ করা যায় কি?
যে আমার, সে তো একান্তই আমার! তার বুকের পুরোটা জমিন, তার হাতের স্পর্শ, তার নিবিড় নিশ্বাস…. সব আমার। তার ভালবাসার স্পর্শ, তার হাসি, তার আলিঙ্ন সব আমার! তার পাশে শুয়ে উন্মুক্ত বুকে স্বপ্ন বুনার অধীকার শুধু আমার। সে শুধু আমার চুলের ঘ্রাণ নিবে! আমার চুলে বিলি কেটে গল্প করে করে ঘুম পারাবে! সে আমার স্বামী। তার পুরোটা শুধু আমার। কেমন করে তাকে যেতে দেই? কেমন করে তার বুকে অন্য কারো জলছবি দেখি? এও কি সহ্য হয়! এর থেকে মৃত্যু যন্ত্রণা ভাল নয় কি?
আজ পরিবার বলে মেনে নাও। সমাজ বলে আমি নষ্টা বলেই স্বামীকে ছেড়ে এসেছি! তারা কেউ আমার ভিতরে ঢুকে হ্নদয়ের গভীরের পোড়া ক্ষতে হাত রেখে দেখেনি, সেখানে কত কষ্টকাদা! বিশ্বাস ভাঙ্গার ঠকঠক হাতুরীর শব্দ ওরা কান পেতে শুনেনি। প্রতিনিয়ত হারানোর যন্ত্রণা হ্নদয়ের মাঝ বরাবর পেড়েক ঠুকে রক্তাক্ত করছে আমায়। ছেড়ে আসা সহজ ছিলনা। কিন্তু কি করি? সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরা স্বামীর শার্টের বুক বরাবর লিপ্সটিকের দাগ… কষ্ট হয়ে আমায় হ্নদয়ে লেপ্টে যায়! গলার কাছটায় কি যেন দলা পাকিয়ে উঠে আসে। মনে হয়, তার বুক খামচে ধরে বলি….ওখানে শুধু আমি ঘুমুবো…!

Add to favorites
626 views