আমি নসিমনঃ ০.৯ জীবনদর্শন -
এইচ বি রিতা
Published on: মে 30, 2018
আমার মা অতি ভাল মা’দের একজন। তিনি ধার্মিক, রক্ষনশীন ও শালীন জীবন যাপন করেন। তিনি দয়ালু। একজন প্রকৃত মুসলমানের যেমন হওয়া দরকার, তার একশো ভাগ না হলেও আশি ভাগ আমার মায়ের মদ্যে বিদ্যমান। একশো ভাগ খাঁটি মুসলমানের জায়গা এই পৃথিবীতে নয়, তাদের অবস্থান আসমানে।
গত এক সপ্তাহ ধরে মা আমার রোজা পালন করছেন। সারা রাত নফল নামাজ পড়ছেন, সাথে দোয়া-দরুদ। তিনি আমার চাকরীর জন্য এতিম খানায় অগ্রিম দান ও করেছেন। আমার মায়ের ধারণা, আল্লাহ্ পাক সন্তানের জন্য কোন মায়ের ইবাদত বিফল করেননা।
আমার চাকরীটা হয়নি। সে কথা মা’কে বলতে পারছিনা। আল্লাহ্ পাক কোন এক অজ্ঞাত কারণে তার ইবাদত বিফল করেছেন। মা জানেন, আমার চাকরীটা না হলে খুব ধকল পোহাতে হবে। আমিও জানি, চাকরীটা না হলে নিজের ও পরিবারের সামগ্রীক ব্যয় বহন করা অসাধ্য হয়ে পড়রে।
কিছু করার নেই। আমার মায়ের ধর্মীয় জীবন দর্শন বাদেও যে নিধর্মীয় জীবন দর্শন বলে কিছু আছে, তা তিনি ব্যাখা করলেও মানবেননা।
তার জীবন দর্শনে সর্বাবস্তায় আসমানী কিতাব অনুসরণ করা, নামাজ পড়া, রোজা রাখা, কোরানের অন্যান্য নির্দেশাবলী পালন করে আল্লাহর অনুগ্রহ বা সোয়াব কামানো যা পরজগতের অন্তহীন জীবনে তার সার্বিক কল্যান নিশ্চিত করবে, সেটাই মূখ্য। সেটা ভালমত পালন করতে পারলেই আল্লাহ্ পাক মনের সকল বাসনা পূরণ করবে বলে তার বিশ্বাস। তিনি এই বিশ্বাসের বাহিরে গিয়ে নিধর্মীয় জীবন দর্শনে বা ব্যক্তি, সমষ্টি, ঘটনা,অবস্থানের ভিত্তিতে জীবনকে দর্শন করতে নারাজ।
পৃথিবীতে মূলত ২ ধরনের জীবন দর্শন রয়েছে। ধর্মীয় (ইসলামি, খৃষ্টীয় ইত্যাদি) এবং নির্ধর্মীয় (মার্ক্সবাদ/সমাজতন্ত্র/ উদারবাদ/ মানবতাবাদ ইত্যাদি)। ধর্মীয় জীবনদর্শনে জীবনের উদ্দেশ্য যতটা সহজে অনুধাবন করা বা ব্যাখা করা যায়, নিধর্মীয় জীবন দর্শনে তা অনুধাবন করা বা ব্যাখা করা আদৌ সম্ভব কিনা আমার জানা নেই। (নিধর্মীয় জীবন দর্শন মানে নাস্তিকবাদ বলে কেউ ভুল করবেননা)!
যখন আমি আমার মা’কে চাকরীটা না হওয়ার কথা জানাবো, মা বিচলিত হলেও আশা হারাবেন না আমি জানি। সেটারও ব্যাখা মায়ের কাছে থাকবে। তিনি মেনে নিবেন, আল্লাহ্ পাক যা করেন তা ভালোর জন্য করেন। তিনি এই দর্শনের বাহিরে গিয়ে জানতে চাইবেন না যে, কেন চাকরীটা হলোনা? তার সন্তানের সম্ভাবনাময় মেধা থাকা স্বত্তেও, চাকরীটা না হলে পরিবার
টিকাতে তার সম্তানের জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হওয়া নিশ্চিত হওয়া স্বত্তেও, এত ইবাদত করা স্বত্তেও, কেন আল্লাহ্ পাক সকল প্রচেষ্টা বিফল করলেন, কিংবা এর পিছনে কি অন্তর্নিহিত ভালো জড়িত, সেই প্রশ্ন তাকে কখনোই বিচলিত করবেনা। আর এটাই তার জীবন দর্শন। যখন একই প্রশ্নগুলো আমার মনে উদ্রেক হয়, সেটা হয়ে যায় মার্ক্সবাদ/সমাজতন্ত্রবাদ জীবন দর্শন।
ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটনা জানতে চাওয়া অপরাধ হয় কেন? আমাকে পীড়ায় পতিত করা যদি আল্লাহ্ পাকের মর্জি হয়, তবে আলহামদুলিল্লাহ! বিনাবাক্যে মেনে নিলাম। কিন্তু যেই আমি তার মর্জিতে পীড়িত হলাম, সেই আমি কেন এর পিছনের অন্তরনিহিত সত্য বা কারণ জানতে পারবোনা? মেনে নিতে, সহ্য করতে, ধৈর্য্য ধারণ করতে সেই অদৃশ্য কারণটা জানার অধীকার অযৌক্তিক তো নয়! সেই কারণ জানতে চাওয়া নাস্তিকবাদ নয়! তার অনুগত সৃষ্টি হিসাবে সেটা আমার অধীকার। পরাজিত নিরস্ত্র আমি নতুন করে যুদ্ধের ময়দানে নামার আগে পরাজিত হওয়ার কারণটা জেনে নিলে সংশোধিত হওয়ার সুযোগ কি পেতাম না!
দাদীমা বলতেন, নসিমন! সবকিছু জানতে চাস নে! সব কিছু জানতে চাওয়া বিরোধ বাড়ায়। যা সহজ গলাধঃকরণ সম্ভব নয়, তা ঢোক গিলে হজম করে নিস, গ্যাচরামো করিসনে!
বাসন মাজতে মাজতে দাদীমা কত সহজে কত জটিল কথা যে বলতেন, তা আজ বুঝতে পারি।
দাদীমা কত কথা বলতেন! ঢোক গিলে হজম হজম করে করে বুকের ভিতর ফুঁলেফেঁপে উঠা ঢেউ; বাঁধের কথা কেন বলেননি!

Add to favorites
313 views