আমি নসিমন বলছি -
এইচ বি রিতা
Published on: জুন 23, 2016
গত ২ ঘন্টা ধরে বিছানায় মটকা মেরে পরে আছি।উঠতে ইচ্ছে করছে না! ওদিকে মা ডাকছে বারবার, ন্যাকিস্বরে বিড়বিড় করছে রান্না ঘরে। কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা।
ভাবছি……
নিয়মের ব্যাতিক্রম কিছু করা যাক আজ, অন্যদিনের চেয়ে ভিন্ন, নতুন কিছু………,আজ যে ঈদ!
রাতুল সেই সাত সকালেই গোল টুপি-নতুন পাঞ্জাবী পরে মসজিদ চলে গেছে পাশের ফ্ল্যাটের আংকেলের সাথে। প্রতি ঈদে, ওদের সাথেই যায় রাতুল।
গতরাতে গিয়েছিলাম মহল্লার গলিগুলোতে। ওখানে মেহেদী উৎসব চলছে। মোড়ের কোণায় কোণায় সবাই ছোট ছোট টেবিল চেয়ার নিয়ে হাতে মেহেদী পড়াচ্ছে! কেনাকাটার রেশ তখনো যায়নি।
রাত তখন ১২টা। রাস্তায় ল্যামপোস্টের আলোটুকুই যা! একটি মেয়ে হাত পেতে বসে আছে চৌকোণা টেবিলটিতে। দোকানী মেয়েটি খুব নিখুঁত শিল্পে মেহেদী পরাচ্ছে হাতে। পাশে স্বামী ভদ্রলোক সেলফোনের টর্চ জেলে ফোনটি ধরে আছেন মেহেদীপরা হাতে! কি অদ্ভুত সুন্দর! ভালবাসাও এত মনোরম হয়…!!!
কিছুক্ষন ঘুরে আমি সেখান থেকে চলে এলাম।
ঘড়ির কাটায় সকাল ৯টা। এখনো শুয়ে আছি!
আচ্ছা…, ঠিক কত বছর এভাবে শুয়ে শুয়ে ঈদ কাটিয়ে দেই? প্রায় ১৪ বছর তো হবেই!
হ্যা, আজ ১৪টি বছর আমি ঈদের রঙ গায়ে মাখিনা। সেই যে ১৪ বছর আগে শেষবার কবে শেষ ঈদপোষাক পরেছিলাম, রিক্সায় চড়ে ঘুরেছিলাম, সামান্য ক’টা ঈদ-সালামী পেয়ে খুশীতে আটখানা হয়ে গিয়েছিলাম, সেই যে ১৪ বছর আগে শেষবার কবে হাতে মেহেদী পরেছিলাম, তারপর আজ অনেকগুলো বছর, তার কিছুই করা হয়নি!
এতগুলো বছর কিভাবে চলে গেল, টেরই পেলাম না! অথচ আজ আমি মধ্যবয়সে উপনীত! এখনো পিছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, দুই বিনুনি করে ছোট আমি স্কুলে যাচ্ছি! টূকটুক করে এঘর হতে ওঘরে হেটে বেড়াচ্ছি, পা ঝুলিয়ে পুকুর পাড়ে অহেতুক পুকুরজলে ঢিল ছুড়ছি!
মনে পড়ে,মা কত বকে বকে আমাকে খাওয়াতো। অসুস্থ্য হলে কেমন অস্থির হইয়ে উঠতো!
এত সুন্দর সময়গুলো কবে যে পিছনে ফেলে এলাম, টেরই পেলাম না!
সেই ১৬তেই সকল পাওয়ার শেষ হলো। তারপর আর কেউ বাবার মত আদর মেখে দামী জামাটা কিনে দেয়নি! কেউ বলেনি মায়ের মত, ” খুকী একটু কিছু তো মুখে দে “!
১৬টি বছর গেলো, দেখতে দেখতে আমি আজ তিরিশোর্ধো নারী! এই এতগুলো বছরে, কেউ সোহাগ করে হাত ধরে ঈদের বাজারে নিয়ে যায়নি! ঘুম ভেঙ্গে কানে কানে ফিসফিস করে কেউ বলেনি, ” নসিমন, ও নসিমন… ঈদ মোবারক তোমাকে”!
১৬ বছর আগে শেষবার বাবা আমাকে রেশ্মী চুরী কিনে দিয়েছিলেন ঈদে। তারপর আর রেশ্মী চুরী পরা হয়নি।
আচ্ছা,তিরিশোর্ধ নারীকে কি বলে? যুবতি, ষোড়শী, পৌড়া, বৃদ্ধা ……? নাহ! তবে? তাদের কি বলে ডাকা যায়? আচ্ছা, বয়সের ব্যবধানে সন্মোধনটা এত জরুরী কেন? এই শ্রেণিবিভাগটার কে তৈরী করেছে? ধীরে ধীরে জীবন থেকে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাওয়া একজন মানুষকে সন্মোধন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, তার অস্থায়ীত্বের স্মরন করিয়ে দেয়া কেন?
নাহ! এবার উঠি! রাতুলের জন্য আজ রান্না করবো। মায়ের জন্য আজ রান্না করবো। আজ মজার মজার সব ডিশ করবো!
ওরা তৃপ্তি নিয়ে খাবে, আমি পাশে বসে দেখবো! আহ! কি শান্তি! এই একটা জায়গায় এসেই সকল আক্ষেপ অনুতাপ মোমের মত গলে যায়! মনে হয়, ভাল আছি!
[[ নসিমন নামটি কাল্পনিক হলেও, চরিত্রটি বাস্তবিক। নসিমন, একজন সংগ্রামী নারী! একজন শক্তিশালী রুঢ় বাস্তবতার নাম। জীবনের সুক্ষ সুক্ষ অনুভুতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে নসিমনের পুরো গল্পটি ]]

Add to favorites
2,131 views