গনহত্যা দিবস -
এইচ বি রিতা
Published on: মার্চ 23, 2017
বিশ্বের যতগুলো গণহত্যা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের ২৫শে মার্চের হত্যাকান্ড ছিলে সবচেয়ে মর্মান্তিক। ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট, অন্যভাবে চিন্তা করলে বলা যায় লাইট দিয়ে খুঁজে খুঁজে বাঙালি নিধন। অপরেশন সার্চ লাইটের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম,সিলেট, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুরের মতো বড় বড় শহরগুলো রাতারাতি দখল করে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে এনে বাঙালিকে দমন করা। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলত বিশ্বসভ্যতার জন্য এক কলংকজনক, জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ঙ্কর গণহত্যার একটি বলে উল্লেখ করা হয়।
এশিয়া টাইমসের ভাষ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করে “তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে।” সে পরিকল্পনা মতোই ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানী আর্মি অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করেন। এ অভিযানে সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষ্যে ২৫ মার্চের আগেই ঢাকা থেকে সব বিদেশী সাংবাদিককে বের করে দেয়া হয়। সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান ক’রে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন। সে রাতেই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন।
তারপরের ৯ মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ঘটনা সকলের জানা। এমন একটি দিনে, এখানে আরো একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাকে এড়িয়ে যেতে হচ্ছে যা বিতর্কিত। যেহেতু যুদ্ধ দেখিনি, সেহেতু বিকৃত ইতিহাস নিয়ে জোড়ালো ভাবে কিছু বলা ঠিক হবেনা। আর সে বিষয়টি হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার মূল ঘোষক কে? পুস্তক বলে ২৫শে মার্চ রাতে আটক হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র সাক্ষর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তার অনুপস্থিতিতে মেজর জিয়ায়ুর রহমান ২৭শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তবে, অপর পক্ষের দাবী,
স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়ায়ুর রহমান। তারা বলেন, “শেখ মুজিব চেয়েছিলেন তাঁর ৬ দফা ভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন আদায় এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেম্বলির একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মসনদে আরোহন। তার এ আকাংখার বাস্তবায়ন ভূট্টোর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে অনেকটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়লে, ১৬ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে ৬ দফা ভিত্তিক ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যান। বাংলাদেশের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষনা করে তিনি নিজ জীবনের ঝুঁকি নিতে চাননি। তিনি জানতেন তার ভূমিকার জন্য পাকিস্তানীরা তাকে হত্যা করবে না। তাই তিনি আত্মগোপন করেননি। তিনি যেহেতু জানতেন তিনি আত্বসমর্পন করবেন তাই তাঁর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনা দেয়া প্রশ্নই আসে না।”
তারা প্রশ্ন রাখেন, “২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমন শুরুর আগ পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র তো বাঙ্গালীদের দখলে ছিল। সেখান থেকে কেন শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষনা করলেন না! ”
স্বাধীনতার ঘোষক যিনিই হোন, আজ জাতির সময় এসেছে এই গণহত্যার সকল ঘটনার বিবরণীর সাথে আগামী প্রজন্মকে পরিচয় করে দেয়ার। বিকৃত ইতিহাস নিয়ে জাতী কতটা সফল হবেন জানা নেই, তবে ২৫শে মার্চ কালরাত্রির সেই ভয়াবহ নৃশংসতা এবং ৯ মাস লাগাতার হত্যাযজ্ঞের বিবরণ জনসমক্ষে নিয়ে আসা সত্যিই প্রয়োজন। এই হত্যাযজ্ঞকে স্মরণ করে একটি দিবস পালন করা কেবল জরুরুরীই না, জাতীয়ভাবে দিনটি নির্ধারণ করে সকল আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি আদায় করাও অতীব জরুরী। আমরা ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের উল্লাস করি, ঠিক আছে। উৎসবপ্রিয় মানুষ উৎসব করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা অর্জিত, তাদের ভুলে গেলে হবে না!
আর তাই, কার্যপ্রণালী-বিধির ১৪৭ বিধির আওতায় ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব আনেন জাসদের সংসদ সদস্য শিরীন আখতার। ইতিমধ্যে, জাতীয় সংসদের স্বীকৃতির পর একাত্তরের ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের দরবারে বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থে ২৫শে মার্চ গণহত্যার মত পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন। একাত্তরের গণহত্যা, সরকারি স্বীকৃতি ত্রিশ লাখ শহীদের মহান আত্মদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। একে বিকৃত করার কোন সুযোগ নেই।
ফুল আতশবাজীতে উল্লাস নয়, এই দিবসকে ঘিরে গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগ্রত করা এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই হতে হবে এর মূল লক্ষ্য। এই দিবসটি হবে এমন একটি দিবস, যার প্রতিবাদ, ঘৃণা ও আন্দোলনে আগামীতে আর কখনই এইরকম গণহত্যার ঘটনা ঘটবেনা। আর তাহলেই ২৫ শে মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্তটি পূর্ণতা পাবে এবং বাংলাদেশের সাথে সাথে বিশ্ব-ইতিহাসেও দিনটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
_____ডার্ক এভিল(HBRita)

Add to favorites
738 views