দোররা -
এইচ বি রিতা
Published on: ডিসেম্বর 13, 2014
বর্তমানে আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় সালিশের মাধ্যমে ফতোয়াবাজি ও দোররা মারার ঘটনা অব্যাহতভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ফতোয়ার শিকার হচ্ছে নারীরা।
কিছু ঘটনার উল্লেখ্য করা হলো-
ঘটনা একঃ মার্চ ৩১, ২০১১
———————————-
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার ঘটনা। কিশোরী হেনার ওপর হামলা করে তাকে ধর্ষণ করে তারই প্রতিবেশি সম্পর্কে ভাই হিসেবে পরিচিত। এরপর হেনার চীৎকার শুনে সবাই ছুটে এলেও ধর্ষকের স্ত্রী তাকে নির্যাতন করে গোপন অঙ্গ ঝলসে দেয়। হেনার বিরুদ্ধে গ্রাম্য সালিশের বিচার করে ফতোয়া জারি করে তাকে দোররা মারা হয়। দোররা মারার সময় সে মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু নির্যাতনের যন্ত্রণায় হেনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তিন দিন পর সে মৃত্যুবরণ করে। কি ভয়ংকর পাশবিক!
লিংকঃ http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/2547
ঘটনা দুইঃ রবিবার ২৩ মার্চ ২০১৪
———————————-
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি নিয়ে এক পর্যায়ে রাগের মাথায় স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেন। তালাকটি দেওয়া হয় কাজির মাধ্যমে নয়, আদালতে হলফনামার মাধ্যমে।তালাক দেওার কিছুদিনের মধ্যেই স্বামী তার ভুল বুঝতে পেরে স্থানীয় চেয়ারম্যান এর কাছে যান।তাঁরা চেয়ারম্যানের কাছে বলেন, তাঁদের মধ্যে সব মিটমাট হয়ে গেছে। তাই তারা আর তালাক চান না। চেয়ারম্যানও তাদের এই আগ্রহ দেখে তালাকের নোটিশটি প্রত্যাহার করেন। তওবা করে পুনরায় সংসার করার জন্য লিখিত আদেশ দেন। সে অনুযায়ী মেয়েটি তার স্বামীর ঘরে ফিরে যান।
কিন্তু বাধ সাধে তথাকথিত সমাজ, গ্রামের মোড়ল সম্প্রদায়। মেয়েটির শিক্ষক বাবাকে একঘরে করে রাখেন গ্রামের মুরব্বি ও মোড়লেরা। তারা সালিস বসান। সালিসে বলা হয়, তালাক হয়ে গেছে। এখন হিল্লা বিয়ে ছাড়া পুনরায় স্বামীর ঘরে পাঠানো অন্যায় হয়েছে। তাই শাস্তিস্বরূপ একঘরে করে রাখা হবে। মেয়েটির বাবা তাঁকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে আসেন। তারপর আরেকবার সালিস ডাকা হয়। সালিসে বলা হয়, মেয়েটিকে ১০১টি দোররা মারা না হলে একঘরে করে রাখার আদেশ প্রত্যাহার করা হবে না।
কথামতো বিচার শুরু। মেয়েটিকে মারা হলো গুনে গুনে ১০১টি দোররা। শর্ত দেওয়া হলো, এই দোররা মারার কথা গ্রামের চেয়ারম্যান ও পুলিশকে বলা যাবে না। মেয়েটির বাবাও তাঁদের কথায় প্ররোচিত হলেন।
লিঙ্কঃ http://server1.corewebdev.com/news/printer/21997
ঘটনা তিনঃ
———————————-
ভয়ঙ্কর এক নির্যাতনের শিকার নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার মেয়েটি। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অপরাধে স্থানীয় সমাজপতিরা সালিশ বৈঠকে জনৈক নারী এবং তার বৃদ্ধ মাকে যথাক্রমে ১০১ ও ৫০টি দোররা মারে (প্রথম আলো ১৩/৬/০৯)। কুমিল্লার দেবীদ্বারে শুদ্ধির নামে বিধবা পেয়ারা বেগমকে ২০২ দোররা মেরে ক্ষতবিক্ষত করে ফতোয়া প্রদানকারীরা (জনকণ্ঠ ২৬/৬/২০০৯)।
লিংকঃ http://www.chalomannoakhali.com/news/380/
ঘটনা ৪ঃ
———————————–
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার বিটেশ্বর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে সন্তানের পিতৃপরিচয়ের স্বীকৃতি দাবি করলে মেয়েটিকে ফতোয়ার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৩৯টি দোররা মারা হয় (প্রথম আলো, ২৪/৫/০৯)।
ঘটনা ৫ঃ
———————————–
রাজাপুর গ্রামের সৌদি প্রবাসী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী হালিমা বেগমের ঘরে শুক্রবার রাতে একই গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে বিল্লাল হোসেন চুরি করতে ঘরে ঢুকলে তাকে আটক করে বাড়ির লোকজন। সকাল হওয়ার আগেই তাকে ছেড়ে দেয় এবং তার সঙ্গে হালিমার পরকীয়ার সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রচার করে। গ্রামে সালিশ বৈঠক বসে। মাতব্বররা ফতোয়া দেয় ৪০টি দোররা মারার। হালিমা দোররার আঘাতে গুরুতর আহত হয়। তাকে বরুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। কুরটনাই এখানে প্রাধান্য পায়।
লিংকঃ http://www.bdlive24.com/news/news_description/5417
ঘটনা ৬ঃ
———————————–
শ্রীমঙ্গলের শাসন গ্রামে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুরুষের সাথে কথা বলায় একজন গৃহবধূকে সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে ১০১ ঘা দোররা মারা হয় (প্রথম আলো ৭/৬/০৯)।
ঘটনা ৭ঃ
———————————–
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধুবিল মেহমানসাহী গ্রামের একজন ধর্ষিতা কর্তৃক আদালতে মামলা করার অপরাধে ওই মেয়েটিকে ১০০ ঘা বেত্রাঘাত এবং দশ হাজার টাকা জরিমানার ফতোয়া কার্যকর করা হয় (প্রথম আলো ৮/৬/০৯)।
ঘটনা ৮ঃ
————————————
নওগাঁয় ‘অনৈতিক’ সর্ম্পকের অভিযোগে হাওয়া বিবি (২৬) নামে এক গৃহবধূকে ১০১টি দোররা মেরে ক্ষতবিক্ষত করেছেন মাতবররা! পরে বিনা চিকিৎসায় তাকে বাড়ির মধ্যে আটকে রেখেছেন।রাণীনগর উপজেলার কালীগ্রাম ইউনিয়নের ছাতার বাড়িয়া গ্রামে খয়বর আলীর স্ত্রী হাওয়া বিবি। একই গ্রামের আব্দুর রহমান খুশুর ছেলে ও খয়বর আলীর ভাগ্নে বাবুর সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে কথা হয়। আর এই কথা বলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের মাতবরদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে যে তাদের মধ্যে অনৈতিক সর্ম্পক আছে।
লিংকঃ http://shadhinkhabor.com/index.php/2013-08-19-09-51-15/1987-2014-07-26-08-44-09
ঘটনা ৯ঃ
———————————-
বখাটে রাসেল এর দ্বারা স্লীলতাহানীর প্রতিবাদ করতে গিয়ে, গ্রাম্য সালিসের ফতোয়ায় , শিবচরের চরাঞ্চলে নির্যাতিত ছাত্রীকে দোররা মেরে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
লিংকঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/RakibBd/29405725
POINT TO BE NOTED-
প্রতিটি দুর্ঘটনাই দোররা কেবল নারীকেই মারা হচ্ছে।
দোররা মারার একটি উল্লেখ্য যোগ্য ঘটনা আমার জানা মতে, উমার (রাঃ) পদ্যপান করার অপরাধে তার ছেলেকে দোররা মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আজ অবধি কেউ কি শুনেছেন, কোন মোল্লা বা গ্রামের মোড়ল মদ, গাজা খাওয়ার অপরাধে কিংবা কোন মেয়েকে উত্যক্ত করার অপরাধে কোন ছেলেকে দোররা মারার নির্দেশ দিয়েছেন? দেননি । দোররা মারার নির্দেশ আসে কেবল প্রেমের ক্ষেত্রেই। তাও আবার শুধু নারীর বেলায়। পুরুষ এখানে অধিকাংশ সময়ই ছাড় পেয়ে যান। ধর্মের নামে অন্ধ সমাজ যেন নিয়ম বেধে দিয়েছেন পুরুষ পরকিয়া করতে পারবে, যৌন হয়রানী করতে পারবে, মদ-গাজাসহ স্ত্রী পাশে রেখে ব্লু ফিল্ম দেখে দেখে হস্তমৈথুন ও করতে পারবে! তাতে ওদের কোন অপরাধ নেই। অপরাধ কেবল নারীর। কেন ?
আমাদের পুরুষপ্রধান পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের জীবনের কোন মূল্য নেই। এখানে ধর্ষকের চেয়ে ধর্ষিতার প্রতিই থাকে সকলের দৃষ্টি। এখানে পুরুষের চেয়ে নারীর অপরাধেই সমাজ বেশী বিচলিত! অসহায়, দরিদ্র বলে নারীকে বঞ্চিত অবহেলিত নির্যাতিত শোষিত দেখতেই সকলে পছন্দ করে। অনেকেই এখনো মনে করেন, পুরুষের এমন একটু আধটু দোষ থাকবেই। কিন্তু মেয়েদের হতে হবে পাক্কা মুসলমান। What a joke man!
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭-এ বলা আছে, কোনো লোক যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তাহলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে যত শিগগির সম্ভব লিখিত নোটিশ দিতে হবে এবং এর একটি কপি স্ত্রীকে দিতে হবে। নইলে তালাক কার্যকর হবে না।
নোটিশ জারি হওয়ার পর ৯০ দিন অতিবাহিত হওয়ার আগে যেকোনো পক্ষ তালাক প্রত্যাহার করতে পারে এবং পূনরায় তারা সংসার শুরু করতে পারে। এতে কোনো বাধা নেই। তালাকের নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন অতিবাহিত না হলে তালাক কার্যকর হবে না। আর পূর্ণভাবে তালাক কার্যকর হওয়ার পর স্ত্রী যদি স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চান, তবে কাবিনের মাধ্যমে যথাযথ আইনগত পদ্ধতিতে পুনরায় বিয়ে করলেই যথেষ্ট হবে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন বিয়ের প্রয়োজন নেই, যদি না এ তালাক তিনবারের মতো কার্যকর হয়। সেই ক্ষেত্রে, (ঘটনা দুইঃ রবিবার ২৩ মার্চ ২০১৪) এর ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখুন। কি ভয়াবহ সময় পার করছেন সেই নারী!
সমাজের অনেক অপরাধই আইনের সংজ্ঞায় পড়েনা। যেমন দোররা মারা, নাকে খত দেওয়া , এক ঘরে করে রাখা, জুতার মালা পরানো। আমি মনে করি, এগুলো একটি সামাজিক শাস্তি। তবে শুধু আমাদের সমাজেই নয়, এই সব সামাজিক শাস্তি পাশ্চাত্যেও রয়েছে যাকে বলা হয় Scarlet Letter Punishment.
আমি অস্বীকার করছিনা, যদিও এসব সামাজিক শাস্তি মানুষের মর্যাদাগত বৈশিষ্টকে ক্ষুন্ন করে, কিন্তু সমাজকে সৃঙ্খলায় রাখতে এই শাস্তি গুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়! দোররা বা অন্যন্য সামাজিক শাস্তিগুলো কেবল নারীকেই কেন জারী করা হবে? ১০০ এর মাঝে ৯৫% ক্ষেত্রেই সকল অপরাধের শাস্তি হিসাবে নারীকেই দোররা মারা হয়। পুরুষ এখানে সুরক্ষিত কেন? এসিডে ঝলসে যাওয়া নারী দোররার স্বীকার। ধর্ষিতা অসহায় নারী দোররার স্বীকার। এমন কি পরকিয়ার মত সম অপরাধে জড়িত বিষয় গুলোতেও নারীরাই দোররার শিকার হচ্ছে! পুরুষ কেন নয়? কিভাবে একজন ধর্ষিতা নারীকে চরিত্রহীনার অপবাদ দিয়ে তাকে দোররা মারা হয় ? কোন অধীকারে সাক্ষ্য প্রমান ছাড়াই কেবল অনুমানের ভিত্তিতে একজন নারীকে দোররা মেরে সমাজের সামনে তার পরিবারের সামনে, তার ব্যাক্তিত্ব ও আত্বমর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয় ?
সমাজ জেগে উঠুক। সমাজের অমানুষ গুলোর বিবেক জেগে উঠুক। সেই বিবেকে একজন নারী কেবল নারী নয়, “মানুষ” হিসেবে স্বীকৃতি পাক সমাজের কাছে, এই প্রত্যাশা।

Add to favorites
414 views