ধর্ষণ দূষনে বাংলাদেশ -
এইচ বি রিতা
Published on: আগস্ট 20, 2017
স্বামীকে হাত পা বেঁধে বরগুনায় বেতাগী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকাকে শ্রেণিকক্ষে দলবেঁধে ধর্ষণ করেন ছয়জন। ঘটনাটি ঘটে গত ১৭ই অগাস্ট।
অভিযুক্তরা হলেন- বেতাগীর হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের সুমন বিশ্বাস, মো. রাসেল, সুমন কাজী, মো. রবিউল, মো. হাসান ও মো. জুয়েল।
উক্ত শিক্ষিকার স্বামী ভারতের পূর্ব মোদেনীপুর জেলার নন্দী গ্রামে বাসিন্দা। বর্তমানে তিনি স্ত্রীকে ফেলে ভারত চলে গেছেন।
বরগুনার শিক্ষকেরা কালো ব্যাজ ধারণ করে মানববন্ধন করেছেন। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে কোন ধরণের প্রতিবাদ নজরে আসেনি। ঘটনাক্রমে ধর্ষিতা শিক্ষিকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন।
ঘটনার পর পাঁচ দিন পার হলেও পুলিশ সব দুর্বৃত্তকে ধরতে পারেনি। একজনকে মাত্র গ্রেফতার করেছেন। পুলিশ বলছে, দুর্বৃত্তরা গা ঢাকা দিয়েছে।অন্যদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, দুর্বৃত্তরা দলের কেউ নন তবে তারা দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বরগুনার দুর্বৃত্তরা কি তবে স্থানীয় নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট কেউ? না হলে পুলিশ কি করে তাদের ধরতে পারেননা? আর আওয়ামী নেতাদেরই বা এত সন্দেহের কারণ কি? কারা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম সাধন করতে পারে? পাঠক নিশ্চয়্যই ভাবছেন না বিএনপি বা জামায়াতের কেউ! তারাই নাম ভাঙাবে, যারা কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত।
আরো একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক আজমিরি বেগমের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদন। তার প্রতিবেদনে বলা হয়, “ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর হাতে ও গালে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।” কিন্তু এর একদিন আগে তিনি বলেছিলেন, ‘পরীক্ষায় সম্ভবত ধর্ষণের আলামত মিলেছে।’
২৪ ঘণ্টার মধ্যে আজমিরি বেগমের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণ কী?
একজন শিক্ষিকাকে স্বামীর সামনে তার শ্রেণিকক্ষে গনধর্ষণ করা হবে, এটা কেমন বর্বরতা? সংখ্যালঘু বলে নয়, মানুষ হিসাবে, একজন শিক্ষিকা হিসাবে তার প্রতি হওয়া অত্যাচারের বিচার কেবল শিক্ষকরাই কেন চাইবেন? সমাজের অনন্য পেশাজীবিরা কেন চুপ করে থাকবেন? কিসের ভয় তাদের? শক্তিশালী দুর্বৃত্তদের? নাকী ধর্ষিতা শিক্ষিকা সংখ্যালঘু বলে?
সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কোটি মানুষ কি করছেন? কেবল সেলফি, আড্ডা আর চ্যাটের মধ্যেই আপনারা সীমাবদ্ধ কেন? এত শক্তিশালী একটি মাধ্যম ফেইসবুক, এখানে আপনারা এমন নিষ্ক্রিয় কেন?
বরগুনায় এই একটি ঘটনাই ঘটেনি। সম্প্রতি আরো কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যা মিডিয়া তেমন আমলে নেয়নি।
গত ১৫ই আগষ্ট, বরগুনা সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে তার চাচাতো চাচা জাকারিয়া ওরফে জাকু।
এ বছরের ২৭শে জানুয়ারীর একটি ঘটনা। বরগুনা আমতলী উপজেলায় এক মা তার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে ও মেয়ের সহপাঠীকে ঘরে রেখে তার অসুস্থ মাকে দেখতে আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের চিলা গ্রামে যান। এ সুযোগে দুই বন্ধু নিয়াজ মোর্শেদ ও বাবুল ফকির কৌশলে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রাতভর ওই দুই স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে। পরে ভোররাতে গ্রামবাসী এ ঘটনা টের পেয়ে দুইজনকে আটক করে পুলিশে খবর দেয়।
২৪শে এপ্রিল ২০১৭- বরগুনা তালতলী উপজেলায় এসএসসি ফল প্রত্যাশিকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেন একই গ্রামের ফজলুল করিমের ছেলে আবু সালেহ।
১২ই মে ২০১৭- বরগুনার তালতলী উপজেলার শিশু শ্রেণির এক ছাত্রীকে (৬) তাইয়েবুর রহমান (১৬) নামের এক বখাটে ধর্ষণ চেষ্টা করে।
২৬শে মো ২০১৭- বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার শারিকখালী ইউনিয়নের চাউলাপাড়া গ্রামের ৬ বছরের শিশু কন্যাকে ধর্ষণ করে ওমর ফারুক নশা (৩৫) নামে একজন।
৭ মার্চ ২০১৭- রাত সাড়ে ১০ টায় আঃ রশীদ এর ঘরে ঢুকে তার স্ত্রী আকলিম কে ধর্ষণ করেন শাহীন ও সেন্টু নামের দুই বন্ধু।
১৪ই জুলাই ২০১৭- বরগুনা প্রি-ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজের বানিজ্য বিভাগের শিক্ষক জসিম উদ্দিন ৭ম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১৪ জুলাই শুক্রবার সাড়ে ১২ টার দিকে পরীক্ষার সিট দেয়ার কথা বলে বানিজ্য বিভাগের শিক্ষক জসিম উদ্দিন তার নিজ কোচিং সেন্টারে যেতে বলে। সেখানে গেলে একটা ওজিফা বের করে শপথ করায় আর বলেন, তুমি মাঝে মাঝে আমার কাছে আসবা তোমাকে পরিক্ষার প্রশ্ন পত্র দিয়ে দিবো বলে শরীরে হাত দেয়। স্যারকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়িয়ে পালিয়ে ছাত্রী আত্মরক্ষা করে। বিষয়টি ছাত্রী বাসায় গিয়ে তার মা ও বড় বোনকে জানায়।
শুধু বরগুনায় নয়, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, গাজীপুর, রংপুর ও নীলফামারীতে বর্তমান ধর্ষণের গাণিতিক হার রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। গত ৩০ জুলাই আমাদের সময় প্রকাশিত একটি সংবাদে, সারা দেশের নারী ও শিশু ধর্ষণ পরিস্থিত তুলে ধরা হয়। এতে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে ময়মনসিংহ, বরগুনা, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, গাজীপুর, রংপুর ও নীলফামারী জেলায় সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ৩৩টি, বরগুনায় ৩০টি, সিরাজগঞ্জে ২৬টি, গাইবান্ধায় ২৬টি, গাজীপুরে ২৫টি, রংপুরে ২১টি এবং নীলফামারীতে ২১টি ধর্ষণের মামলা রেকর্ড হয়। এ হিসাবের পরেও বরগুনার স্কুল শিক্ষিকাকে ধর্ষণের ঘটনা যোগ হয়েছে।
অন্যদিকে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৭ জেলায় ধর্ষণের মামলা সবচেয়ে বেশি রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে বরগুনায় ৫৬টি, টাঙ্গাইলে ৪৫টি, কুমিল্লায় ৪৫টি, গাজীপুরে ৪১টি, হবিগঞ্জে ৩২টি, সিরাজগঞ্জে ৩১টি এবং ময়মনসিংহে ৩০টি ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করা হয়। জানুয়ারি থেকে মার্চ ৩ মাসের চেয়ে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৩ মাসে ধর্ষণের মামলা বেশি রেকর্ড হয়েছে।
সামাজিক অবক্ষয়ের চূরান্ত রুপ হচ্ছে ধর্ষণ। ধর্ষণে দূষিত পুরো বাংলাদেশ। সমাজের সর্বস্তরে চলছে ধর্ষণের দুর্দান্ত প্রতিযোগিতা। কে ঠেকাবে এই অনৈতিক অপকর্ম?
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ নাগরিকের আইনের অধিকার লাভের মৌলিক অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।”
আমাদের সংবিধান বলছে, আইনের কাছে সমান আশ্রয় লাভের অধিকার শুধু অধিকারই নয়, এটা আমাদের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত। মৌলিক অধিকার হচ্ছে এমন অধিকার যা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রদান করতে আইনত বাধ্য।
প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করায় হাইকোর্টের তার রায়ে নির্দেশ দিয়েছেন, অভিযুক্ত আসামীদের হয় ফাঁসি দেওয়া হবে না হলে গুলি করা হবে। শুধু হত্যার চেষ্টায় কঠিন রায় শোনানো হয়েছে। আমাদের দেশে যখন জনসম্মূখে বিশ্বজিৎদের কুপানো হয়, যখন তনুদের-পূজাদের ধর্ষণ করে যোনী ছিড়ে ফেলা হয়, তখন সে মামলার আসামীদের নানান অজুহাতে খালাস দেয়া হয়।
আমরা সামবাধানিক নাগরিক অধীকার হতে বন্চিত।
——
ডার্ক এভিল(HB Rita)

Add to favorites
630 views