প্রবাহমান জীবন ও কিছু কথা- পর্ব ৪ -
এইচ বি রিতা
Published on: জুন 6, 2015
সংসারী মানুষ অনেকটা মাটিতে ছড়িয়ে থাকা গাছের শিকড়ের মত। এই শিকড় এর প্রভাব খুব বিস্তৃত, খুব গভীর। শিকড় যেমন শক্ত পায়ে মাটি আঁকড়ে জড়িয়ে থাকে, গাছ উপড়ে ফেললেও শিকড়ের শাখা প্রশাখাগুলো গেঁথেই থাকে মাটিতে আজীবন, সংসারী মানুষগুলোও ঠিক তেমন; সুখ-দুঃখ, পাওয়া না পাওয়ার হিসেবের বেড়াজালে একে অপরকে মায়ার শিকড়ে জড়িয়ে রাখে আজীবন। সংসার ভাঙে, সম্পর্ক ভাঙে।মায়ার এই পিছুটান আজীবন মানুষকে দাপিয়ে বেড়ায়।
সংসারটা অনেকটা উড়নচণ্ডীর ব্যাগ কাঁধে ট্রেইন ভ্রমন এর মত। ব্যাগে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সব জিনিস পত্র রাখা জেনেও বহন করতে কষ্ট হয়। আবার ফেলেও দেয়া যায়না, সবই প্রয়োজনীয় জিনিস-পানির বোতল , ব্রাশ , খাবার,গামছা, জামা, জুতা, ঔষদ! ফেলে দিলে ভার কমে যেত, ভ্রমনটা আরেকটু সহজ হত। সংসারটাও ঠিক এমনই । ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া- পাওয়া,হাসি-কান্না, দায়িত্ব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিন্দু বিন্দু জলকনা বহন করে চলতে হয়। মাঝে মাঝে খুব ভার লাগলেও ফেলে দেয়া যায়না। আর যারা প্রয়োজন বোধ করে না তারা অনায়াসে ব্যাগটা ফেলে দিয়ে সামনের দিকে ছুটে ক্ষণিকের জন্য ভারমুক্ত হতে। কোন স্টেশনে ট্রেইনের গতি থামলেই জৈবিক চাহিদায় পিছু ফিরে আবার ব্যাগটি খুঁজে। আফসোস করে!
সংসারটি ঠিক এমনি।সংসার যেন অনেকটা কারাগারের মত। বড় বড় উঁচু দেয়ালে সংসার মানুষ নামক প্রাণিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। মানুষ সংসার ছেড়ে পালালেও, সংসার মানুষের পিছু ছাড়েনা!
আর সংসার ছেড়ে গেলেই কি সব ভুলে যাওয়া যায়? পুরণো কথা, পুরানো স্মৃতিরা বার বার কি ফিরে আসেনা? পুরানো সেই মুখ, মুহূর্তগুলো কি নীরবে মানুষকে কাঁদায় না? ছেড়ে যাওয়া কি এত সহজ? মানুষ ছেড়ে গেলেও সংসার কি তাকে ছাড়ে ? সেই পুরণো ছাতা, পুরনো চা এর কাপ, প্রিয় গানগুলি, ধূলিপরা পুরানো দেয়ালে টানানো ক্যালেন্ডার, শব্দহীন কিছু আর্তচিৎকার, বিকেলের রোদে বারান্দায় বসার সেই আধা ভাঙা ইজি চেয়ারটা, ছোট্ট ছোট্ট ভালো লাগার মুহূর্তগুলো, না বলা কিছু কথা……… পিছু কি টানেনা? মানুষ এর মুক্তি কিসে? কিছুই তো ছেড়ে যাওয়া যায়না। মানুষ আসলে কখনই স্বাধীন ছিলনা; পরাধীনতার শিকলে আজীবন মানুষ বন্দি।
পাওয়া না পাওয়ার হিসাবগুলো যখন স্পষ্ট হয়ে উঠে, তখনই মন বিবাগী হয়। বিবাগী মানুষ সংসার ছেড়ে পালায় । পুরানো হিসাবের খাতা ছুঁড়ে ফেলে, নতুন মলাটে মোড়ানো চকচকে খাতায় আবার লিখা শুরু করে। নতুন করে কি আসলেই লিখা যায়! পুরাতনকে মাড়িয়ে নতুন করে শুরু করা কি খুব সহজ? সহজ না। নতুন করে অনেক কিছুই শুরু করা যায়না। কোন এক বিষণ্ন রাতে মানুষ যখন নতুন করে স্বপ্নের কোলে ঢলে পড়ে, পুরানো বীভৎস সংসারের জমে থাকা পোকা মাকড়গুলো মাঝ রাতে স্বপ্নের দেয়াল বেঁয়ে উঠে আসে আলোতে, তারপর দাঁতের আঁচড়ে কাটতে থাকে নতুন খাতার পৃষ্ঠাগুলো। লিখা আর হয়না। আবারো মানুষ নতুন পৃষ্ঠায় লিখার চেষ্টা করে।সংসারের এই অন্তহীন শুরুর খেলা চলে আমৃত্যু!
অনেক কিছুই ছেড়ে যাওয়া যায়না। আর ছেড়ে গেলেই বা কি? মানুষ কি কখনো পেরেছে নিজেকে একা সুখি করতে? দুইয়ের সম্মিলন হলেই না তবে সুখ! আর যারা পেরেছে, তারা মহান।লালন, বাউলরা পথে পথে তাদের লিখার মাঝে, তাদের ভাবনায়, আজীবন সৃষ্টির রহস্য খুঁজে বেড়িয়েছেন। ওরা আমাদের দৃষ্টিতে নিঃস্ব হয়ে ছিলেন। সৃষ্টিকর্তার দর্শন কতটা পেয়েছেন কে জানে!
সাধারণ মানুষ কতটা পেরেছে সংসারের মায়া ত্যাগ করতে? কেউ পারেনা। আমরা মাটিতে শিকড় জড়ানোর মতই জড়িয়ে গেছি সংসারের মায়ায়। মায়া মানুষের সব চেয়ে বড় দুর্বলতা। মায়া জিনিসটা না থাকলে সংসারের পিছুটানও কিছুটা কম হত!

Add to favorites
1,739 views