বন্যাঃ নারী ও শিশুর দুর্ভোগ -
এইচ বি রিতা
Published on: আগস্ট 11, 2017
২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের রাতে জন্ম নেওয়া শিশুটির কথা আশাকরি সবাই মনে রেখেছেন, যার নাম রাখা হয়েছিল সিডর। বাগেরহাটের মোংলার চিলা এলাকার সেন্ট মেরিস গির্জাসংলগ্ন আশ্রয়কেন্দ্রে জন্ম হয় সিডরের। সিডরের জন্মের সময় সেখানে ছিল না কোনো ডাক্তার বা কোনো নার্স। সিডর ভূমিষ্ঠ হয়ে পানিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। তার মা সাথী সরকার এমন অসুস্থ্য পরিবেশে দিশাহীন সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল দুজনই।
এই ছিল মাত্র একজন সাথীর দুর্ভোগের সাক্ষ্য। বন্যাকবলিত এলাকায় প্রতিদিন নারীরা সাথীর মত হচ্ছেন নানান দুর্ভোগের শিকার।
বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। এদেশে একেক পর এক ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসসহ নানা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ লেগেই থাকে। আর এসব দুর্যোগের কারণে পুরুষের থেকে নারী ও শিশুরা বেশী ভোগান্তিতে পড়েন। সরকার যে একবারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি, তা নয়। সরকার ইতিমধ্যে নানা ধরনের উন্নয়নমূলক নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও, নারীর দুর্ভোগ মোকাবেলায় এসব ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ৫১ উপজেলায় ৩০ লক্ষাধিক মানুষ বন্যাকবলিত। বন্যায় মানুষের বাড়ি, ঘর, উঠোন, পায়খানা, রান্নাঘর সব পানিতে একাকার। জীবন কিন্তু থেমে নেই! সাথীর মত অনেকেই বানভাসি সন্তান প্রসব করছেন, কেউ কেউ আসন্ন প্রসবা, বাকিরা রজঃস্বলা। একজন নারীর সন্তান প্রসবের পর দীর্ঘদিন ধরে তার ঋতুকাল চলে। এ সময় নারীর বারতি যত্নের প্রয়োজন, প্রয়োজন পুষ্টিকর খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা। আমাদের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র নারীরা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করার সামর্থ্য রাখেন না। তাঁরা ঋতুকালীন সুরক্ষার জন্য দেশীয় পদ্ধতিতে পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে বারবার ধুয়ে-শুকিয়ে আবার ব্যবহার করেন। সে কাপর ধুতেও ডেটল বা স্যাভলন ব্যবহার করেন অনেক সতর্কবান নারী। সন্তানের জন্যও তারা ডাইপার ব্যবহার করেন না, সুতি কাপরের ছোট কাঁথা ব্যবহার করেন কিংবা কাপরের টুকরো। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে শিশুর কাঁথা-কাপড়, নারীর রজঃ সুরক্ষার কাপড় ও পরিধেয় বস্ত্র সহজে শুকিয়ে গেলেও একটানা বৃষ্টি-বন্যা-দুর্যোগের সময় শুকানো সম্ভব হয়না। তাছাড়া নিজ গৃহে মেয়েদের রজঃ সুরক্ষার কাপড় সাধারণত শুকাতে দেয়া হয় ঘরের আলনায় কাপরের পিছনে, কিন্তু আড়ালহীন খোলা বাঁধ বা সড়কের ওপর হাজারো মানুষের সামনে নারীর রজঃ সুরক্ষার কাপড় ও পরিধেয় বস্ত্র অর্থাৎ প্যান্টি-ব্রা শুকাতে দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?
দেখা যায় দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে নারীর সংসারের কাজ অনেকগুন বেড়ে যায়। খাবার রান্না করা, রান্নার জন্য জ্বালানি ও পানি সংগ্রহ করা, গৃহস্থালির জিনিসপত্র থেকে শুরু করে গৃহে পালিত হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল রক্ষার চেষ্টা করা এবং শিশুকে নিরাপদ স্থানে রাখার চেষ্টা করা, সাধারণত নারীরাই বেশী করেন। এ সমস্ত কাজ করতে গিয়ে অনেক নারী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় সাধারণত পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কমে যায় এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীর মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। আবার দেখা যায় নারীরা শারীরিকভাবে পুরুষদের তুলনায় দুর্বল হওয়ায় এবং স্বামী বা উপযুক্ত ছেলে সন্তান না থাকায়, অনেক সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে যে ত্রাণ পাঠানো হয়, তা নারী অবদি পৌছায়না। নারীদের সঙ্গে থাকে তাঁদের শিশুরা। ফলে পরোক্ষভাবে নারীর সাথে শিশুরাও ক্ষতির শিকার হয়।
আরো একটি বড় সমস্যা যা নারীরা ভোগ করেন, তা হলো প্রশ্রাব-পায়খানা ও গোসলের সীমাবদ্ধতা। বন্যাকবলিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত শৌচগার, গোসলখানা ও পানীর ব্যবস্থা না থাকায় নারীরা হচ্ছেন লজ্জ্বাকর দুর্ভোগের শিকার। শৌচাগার ব্যবহারের জন্য ঘন্টা ভরে লাইন দিয়ে থাকতে হয় নারীদের। গোসল করার কোন ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া খাওয়ার পানির জন্য যেখানে আশ্রয়কেন্দ্রের সবাইকে পৌরসভার গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে হয়, সেখানে শৌচ সাধন ও গোসলের পানি কতটুকু তারা পান? পানির গাড়ি দেখা মাত্রই তা সংগ্রহ করতে হুড়োহুড়ি লেগে যায় নারী-পুরুষ সবার মধ্যে। যার গায়ে জোর বেশী, তিনিই গা মারিয়ে লাইনের প্রথমে দাঁড়ান। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ পাশের কোন বাড়ীতে যান গোসল করতে। কিন্তু বাকিরা?
শিশুদের জন্য সরাসরি কোনো ত্রাণসামগ্রীর ব্যবস্থা কোন আশ্রয়কেন্দ্রে নেই।
বন্যাকবলিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অপর্যাপ্ত শৌচাগার, বিশুদ্ধ খাবার পানির সাথে রয়েছে শিশুখাদ্যের সংকট। বয়স্করা ত্রাণ পেলেও শিশুদের উপযুক্ত কোনো খাবার নেই। যেসব শিশু শুধু মায়ের বুকের দুধের ওপর টিকে থাকে, তারা বাধ্য হয়ে বড়দের খাবারই খাচ্ছে। এতে করে অনেক শিশু পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের ফলে বন্যার পানি ভয়াবহ রকম দূষিত হয়ে পড়ছে।
বন্যাকবলিতদের জন্য সরকারি ত্রাণের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে অনেকে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। ফেসবুকের মাধ্যমে, অনন্য সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও মানবকল্যানে অনেকেই সমান পারদর্শীতার সাক্ষর রাখছেন। তাদের সবাই যদি চাল-ডাল-চিড়া-মুড়ি-স্যালাইনের পাশাপাশি দুর্ভোগরত নারীদের জন্য স্যানিটারী ন্যাপকিন সর্বরাহ করার দায়ীত্ব নেন, তবে নারীর ব্যক্তিগত শারীরিক অসুবিধার দিনগুলো কিছুটা স্বস্থির হবে। সেই সাথে সরকারকে প্রতিটা ত্রাণকেন্দ্রে শৌচগার সংখ্যা বারাতে হবে, শিশুখাদ্য সংকট মোবাবেলায় দায়ীত্বশীল পদক্ষেপ নিতে হবে।
ডার্ক এভিল(HB Rita)

Add to favorites
696 views