মন্টুর ময়না বু -
এইচ বি রিতা
Published on: ডিসেম্বর 20, 2015
১৯৭১ এর এপ্রিল মাস। জন্মভুমি কেশবপুরে তখনো পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার ছোঁয়া লাগেনি। তবে মাঝরাতের নির্জনতায় দুই একটা গুলীর শব্দ কানে আসতো। একদিন খেতে বসে বাবা বলছিলেন,
“মন্টু রে, দেশে যুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে। পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় অনেক লোক মাইরা ফেলসে। কবে জানি আমাগর দিকে আহে।”
আমি তখন ৯ বছরের কিশোর।বাবার কথার সারমর্ম তেমন মাথায় ঢুকেনি।
কয়েক সপ্তাহ পরেই, এক বিকেলে পাশের গ্রাম থেকে ফুপু চলে এলেন আমাদের বাড়ীতে। বললেন, ওদের গ্রামে পাক হানাদাররা ঢুকে পরেছে। বাড়ী ঘর পুড়ছে, লুটপাট করছে, মানুষ ও নাকি মারছে।
ফুপু আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়ার কিছু দিনের মধ্যেই দেশ জুড়ে পাক হানাদার বাহিনীর নাশকতা বৃদ্ধি পেতে লাগলো।
তারা নির্বিচারে মানুষ খুন করতে লাগলো। পাক হানাদাররা শহর ও গামের অসংখ্য বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিতে লাগলো। নারী বৃদ্ধা শিশু কেউ রেহাই পেলনা। বিভিন্ন হোটেল, কলেজ, প্রাসাদ, অফিস, আদালত, থেকে শুরু করে গরীবের কুঁড়েঘর সব ধ্বংস করে দিতে লাগলো।
দিনটি ছিল শুক্রবার। সাধারণত প্রত্যুষে মানুষের ঘুম ভাঙ্গে পাখির কলতানে।কিন্তু সেইদিনটি আমাদের গ্রামবাসী ও আমাদের পরিবারের জন্য ছিল এক ভয়াবহ পৈচাশিক যাতনার।বিশাল আকৃতির জঙ্গী বিমানের বিকট শব্দ,মেশিন গানের ব্রাশ ফায়ারে আমাদের তন্দ্রা কাটে । বেলা যত বাড়তে থাকলো, গুলির শব্দ আর মানুষের চিৎকার ততই স্পষ্ট কানে বাজতে লাগলো।
বাবা বললেল,আজই গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে। যা আছে সব বেঁধে নাও। মা আমাদের কাঁথা বালিশ আর কিছু কাপর জড়ো করে পুটলা বেঁধে আনলেন। ফুপু ও তার দুই মেয়ে সহ, তখনই বাবা আমাদের নিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পরলেন।
ততক্ষনে গ্রামের মাঠে নেমে পরেছে শতশত মানুষের ঢল। যে যেভাবে পারছে দৌড়াচ্ছে। সবার একটাই লক্ষ্য, নদি পার হতে হবে। নদির ওপারে কি আছে, তা কারোই জানা নেই। তবু মানুষ ছুটছে প্রাণপণে নদীর ঘাটে।
বড় বড় হেলিকপ্টার গুলো মাথার উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। কি বিকট শব্দ। শত শত গ্রামবাসীর ভয়ার্ত চোখ। মানুষের অসহায় চোখ এত করুন, এত বেদনাময়, তা সেদিন দেখেছিলাম।
সকলের সাথে আমরাও দৌড়াচ্ছি। হঠাৎ করে মা থেমে গেলেন। এদিক ওদিক ভয়ার্ত চোখে তাকাতে লাগলেন। তারপর বুক ফাটা চিৎকারে বলতে লাগলেন,
“আমার ময়না কই? ও ময়নার বাপ, আমার ময়না তো আসেনাই। ওর গায়ে জ্বর, ও তো ঘুমাই ছিল!”
বলেই মা সবার ছোট বোনটিকে কোলে নিয়েই উল্টা বাড়ীর পথে দৌড়াতে লাগলেন। মায়ের পিছু পিছু আমরাও দৌড়াতে লাগলাম ময়না বু কে আনতে।
আমরা ছিলাম ৫ ভাই বোন। ময়না বু সবার বড়। বয়স ১৩। তারপর আমরা ৩ ভাই। সবশেষে ৬ মাসের বোনটি।
যখন বাড়ীর উঠোনে এসে পৌছুলাম, ততক্ষনে পাক হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়ীর একাংশ জ্বালিয়ে দিয়েছে। আতঙ্কে আমরা কি করবো বুজতে পারছিলাম না।আমাদের দেখা মাত্রই খান সেনারা ঘর থেকে বের হতে হতে গুলি শুরু করে। আমি সবার পিছনে থাকায় দৌড়ে গিয়ে লুকাই রান্না ঘরের গোলার ভেতর। গোলা খালি ছিল বলেই আমি লুকাতে পেরেছিলাম। হাতে থাকা কাঁথা বালিশ এঁটে দেই গোলার মুখে। আর ওদিকে খান সেনাদের গুলিতে পাখীর মত মাটিতে লুটিয়ে পরে আমার পরিবারের ৯ জন।
ভীষন আতঙ্কে আমি জ্ঞান হারাই।
যখন জ্ঞান ফিরে, তখনো আমি গোলার ভিতর। চোখ খুলেই দেখতে পাই এক নারকীয় দৃশ্য। অতটুকুন বয়সে, কি হচ্ছিল ঠিক দিশে করতে পারিনি। তবে বুজতে পেরেছিলাম, ময়না বু কে ওরা খুব কষ্ট দিচ্ছে। একের পর এক খান সেনা ময়না বু’র উপর চড়ছিল, আর ময়না বু রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় বু আমার নীরব হয়ে যায়। নিথর দেহটি নিয়ে ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত পালা করে খেলতে থাকে।
আমি নিশ্চুপ স্বার্পপর ৯ বছরের কিশোর, তখনো গোলার ভিতর লুকিয়ে। চোখের পলকটি ও পরেনি আমার। আমি শুধু দেখছিলাম। চোখের পানির ফোঁটাটি গাল গড়িয়ে মাটিতে পরতে দেইনি,চেটে নিচ্ছিলাম। যদি শব্দ হয়! যদি ওরা আমায় দেখে ফেলে!
এক সময় খান সেনারা চলে যায়। চারিদিক নীরব হয়ে আসে। আমি গোলা হতে বের হয়ে আসি। ময়না বু’র দেহটি রান্নাঘরের মেঝেতে পরে ছিল। আমি ওদিক ওদিক ভাল করে দেখে নিয়ে কাছে গিয়ে বসি। নগ্ন গায়ে গোলা হতে কাঁথাটি এনে পেচিয়ে দিই। সারাদিন না খাওয়া বলেই হয়তো আমি গায়ে জোর পাচ্ছিলাম না। কোনরকমে ময়না বু কে পা ধরে টেনে টেনে, রান্না ঘরের পিছনের ডোবার কাছটায় নিয়ে যাই। ব্যাথায় ময়না বু কঁকিয়ে উঠে।কোন কথা বলেনি।
যদি আবার খান সেনারা আসে? যদি আবার ময়না বু কে কষ্ট দেয়? আবার কাপর খুলে? না না! বু কে বাঁচাতে হবে!
ময়না বু কে টেনে টেনে গলা অবধি ডোবায় নামালাম। রাতভর ময়না বু কে নিয়ে দুর্গন্ধময় ডোবায় জড়িয়ে ধরে লুকিয়ে রইলাম। ময়না বু তখনো নীরব।
ভোরের আলো ফুটে উটলো। দু’চার জন করে মানুষ এদিক ওদিক বের হতে লাগলো। মসজিদের বুড়ো ইমাম কাকাকে তসবি হাতে এদিকে আসতে দেখেই ডাকলাম। কাকা দৌড়ে এলেন। আমাদের ভাই বোনকে ডোবা থেকে টেনে তুললেন।
তারপর কিছুক্ষন ময়না বু’র হাত টিপে, বুকে কান পেতে বললেন,
“মন্টুরে, ময়নায় তো কক্ষন মইরা গেছে!”
মনে পরে, আমি তখন শুধু ময়না বু’র শরীরটা জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম। কাকাকে বললাম,ময়না বু’কে কোথায় মাটি দেবো! কাকা বললেন,
“ময়নারে মাটি দেয়া যাবে না। গ্রামে কুন সময় জানি খান সেনা ঢুকে আবার! চল নদিতে ভাসাই দেই। তারপর তুই আমার লগে গ্রামের বাড়ি চল। আইজি পলাইতে হবে। নাইলে মারা পরবি!”
ময়না বু’কে নদিতে ভাসিয়ে দেয়া হলো। আমার বু, আমার ১৩ বছরের লক্ষী বু, রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ভেসে গেলো নদির জলে!
দেশ স্বাধীন হল। বড় বড় দালান কোঠা হলো।আবারো মানুষ হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলো। আমি শুধু হাসতে ভুলে গেলাম।
ছোট ছোট শিশুরা মা-বাবার হাত ধরে যখন স্কুলে যায়, আমার ভিতরে জ্বালাপোড়ন হয়। চিৎকার করে কাঁদি। কেউ শুনে না। কারো কিছু যায় আসে না।
যখন রাস্তার পাশে, পার্কে, ভাই বোন হাত ধরাধরি করে খেলে, তখনো চিৎকার করি। সবাই আমায় পাগল ভাবে। বিস্ময় নিয়ে, বিরক্তি নিয়ে তাকায়। কারো কিছু যায় আসে না।
আজ কেবলই মনে হয়, ময়না বু বেঁচে থাকলে কেমন হতো? লাল শাড়ীতে বউ সাজতো কি? তার ঘরে বাবু হতো কি? বাবুটার নাম কি হতো ?
আমায় আদর করে বলতো কি,
”এই মন্টু এদিকে আয়, দেখ, তোর জন্য নতুন শার্ট কিনেছি,। এই মন্টু এত বড় চুল রেখেছিস কেন?”
বু কি আমায় লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া নিয়ে মারতো?
আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর, কত খান সেনা হয়তো বিভোরে ঘুমায়। কত রাজাকার ঘুমায়। আমি ঘুমাতে পারিনা।চোখের পাতা এক করতে পারিনা। রাত হলেই অদ্ভুত এক ভয়ে অসহনীয় এক তীব্র ব্যাথায়, আমার নিঃশ্বাস থেমে যেতে চায়। আজ শুধু মনে হয়, আমি স্বার্থপর। সেদিন যদি প্রাণের ভয়ে গোলায় না লুকাতাম! সেদিন যদি খান সেনাদের টুঁটি চেপে ধরতাম! আমার ময়না বু কি তবে বেঁচে থাকতো? সেদিন যদি ময়না বু’কে বাঁচাতে ফিরে না আসতাম, তবে কি আমার পরিবার বেঁচে থাকতো?

Add to favorites
1,786 views