যেভাবে কেটেছে রমজান মাস -
এইচ বি রিতা
Published on: মে 28, 2019
রমজান একটি পবিত্র মাস। প্রত্যক মুসলমানের জন্য এ মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। ছোটবেলায় রমজান মাসের গুরুত্ব খুব একটা বুঝতামনা। তখন রমজান মাস মানেই ছিল রোজা রাখা, আর রোজার মাসে পাল্লা দিয়ে কোরআন শরীফ খতম করার পাশাপাশি মজাদার সব ইফতারি খাওয়ার লোভ, রোজা শেষে ঈদে নতুন জামা পাওয়া ও বন্ধুদের কার্ড দেয়া ছিল সীমাহীন খুশীর ব্যাপার।
আমাদের পরিবারের লোক সংখ্যা ছিল অনেক। অফিসের কর্মচারী, বাগানের মালী, গরু দেখাশুনা করার লোক(আমাদের বাড়ীর পিছনে আব্বা নিজেদের গরু পালতেন, গরুদের থাকার ঘরকে বলা হতো গোয়ালঘর), বাড়ীর কাজের লোক, ভাই-বোন, ভাগনা-ভাগ্নি, ফুপুর পরিবার…. সব মিলিয়ে লোক সংখ্যা ছিল ৫০ এর উপর। আর আব্বা জন দরদী নেতা হওয়ার সুবাদে বিনা দাওয়াতেই রোজ একের অধীক লোক আমাদের বাড়ীর স্থায়ী মেহমান ছিল। বিশেষ করে রোজার মাসে ১০/১২ জন এলাকার অসহায়দের জন্য সমানভাবে ইফতারের প্লেট সাজানো হতো। পাটি বিছিয়ে লম্বা বারান্দায় ইফতারের আয়োজন করা হতো। ভূসির শরবতের সাথে বেলের শরবত ছিল কমন। ছোলা, পিঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনী, দই বড়া, বুন্দিয়া, খেঁজুর, মুড়ি, নানান ধরণের ফল থাকতো ইফতারের প্লেটে। কোন কোন দিন বেসন তেলে চিকেন ফ্রাই! সকল ইফতারী বানানো হতো ঘরে। আম্মা, বড় আপা, ভাবীরা ও কাজের মহিলারা দুপুর থেকে শুরু করতেন ইফতার বানানো। আমার আম্মাকে খুব কম দেখেছি ইফতারের সময় সবার সাথে বসে ইফতার করতে। নিজে শুধু খেঁজুরটা মুখে পুড়তেন। বাকি খাবারগুলো হাতে তিনি একে ওকে খুঁজতেন ইফতার করানোর জন্য। প্রায়ই এ নিয়ে আম্মাকে সবার কথা শুনতে হতো। তিনি বলতেন, একজন রোজাদারকে ইফতারি করানোতে অনেক সওয়াব।
আমার আব্বা ছিলেন খুব রাগী। চুন থেকে পান খশলেই রোজার মাসে আব্বার রাগ হুটহাট বেড়ে যেত। আমরা তখন ভয়ে তার সামনে যেতামনা। আমাদের বাড়ীতে শরবত করা হতো গোসলের সাইজ বড় বালতিতে। প্রায়ই আব্বা নিজে শরবত করতেন। শরবতে এপি মেশানো হতো। বেল চিপে দিতেন মেঝুমা, ছোট মা প্লেট সাজাতেন। আব্বা ছিলেন ডায়াবেটিক, প্লেটে থাকতো কিছু বারতি খাবার। আমাদের সবার নজর থাকতো সেখানে। আব্বা যার প্লেটে তার প্লেট থেকে খাবার তুলে দিবেন, সেই ছিল ভাগ্যবতী/ভাগ্যবান। অর্থাৎ তাকেই আব্বা বেশী ভালবাসেন— এটা ছিল আমাদের সবার ধারণা। তাই ইফতার করতে বসে আমাদের সবার মধ্যে উত্তেজনা কাজ করতো। আজ আব্বা কার পাতে খাবার দিবেন…..!
আমার দাদীমা ছিলেন ভিন্ন রকমের একজন মানুষ। তিনি অন্যদের ইফতারী করাতে খুব ভালবাসতেন। আরো একটা জিনিস আমার দাদীমা করতেন, কখনো কোন অসহায়কে খালি হাতে ফিরাতেন না। যেই আসতো, হয় চাল কিংবা খুচরা টাকা দিয়ে বিদায় করতেন। দাদীমা বলতেন, ‘কখনো এই বাড়ী থেকে যেন কোন অসহায় খালি হাতে না ফিরেন।’
রোজার মাসে দাদীমা তার এসব কাজে আরো বেশী মনযোগ দিতেন।
যা বলছিলাম, ইফতারের পর তারাবী পড়ে সবাই ভাত খেত। মাছ মাংসের সাথে শুটকি তরকারী ছিল বেশী পছন্দ সবার। প্রায়ই মেজু মা কান্জির চালের(নরসিংদী ভাষায় সপ্তাহ ব্যাপী পানিতে চাল ভিজিয়ে রেখে বিকট দূর্গন্ধ হওয়া চাল দিয়ে ভাত ফুটানোকে কান্জির চালের ভাত বলে) ভাতের সাথে ১০/১২ পদের ভর্তা করতেন রোজার মাসে। এটা নরসিংদীবাসীর প্রিয় খাবারগুলোর একটি।
তারপর আসতো সেহেরীর সময়। ২টা বাজতেই আম্মা গরম ভাত চড়াতেন। মাছ মাংস বা অনন্য তরকারীগুলো রান্না করে রাখা হতো রাতে। সেহেরীর সময় শুধু গরমে দিত। ৩টা বাজতেই বাড়ীর সবাই উঠে যেত।
সেহেরীতে মাস মাংসের পর দুধ-কলা মেখে ভাত খাওয়া ছিল কমন। সেহেরীতেও দেখতাম কিছু অসহায়দের বারান্দায় খেতে দেয়া হতো প্রতিদিন।
আমি তখন স্কুল বালিকা, ছোট। ঘুম ঘুম চোখে উঠে কিছুই খেতে পারতামনা। প্রায়ই আমি শুধু পানি খেয়ে রোজা রাখতাম। আম্মা বলতেন, সেহেরী না খেয়ে রোজা হয়না। তাই পানী পান করতাম। দুধ-কলা, আম বা দই আমি কখনোই খেতামনা সেহেরীতে। খেলেই কেমন বিশ্রী ঢেঁকুর উঠতো সারাদিন।
রোজার মাসে আরো একটা বিষয় ছিল আমাদের বাড়ীতে, তা হল- কোরআন খতম দেয়া। আমরা সব ভাই বোন ও ভাবীরা কোরআন খতম করতাম। কে কতবার খতম করতে পারে তা নিয়ে চলতো প্রতিযোগীতা। কম করে হলেও ৩ বার তো কোরআন খতম করতামই।
রোজার শুরুতে খুব এনার্জি থাকলেও মধ্যভাগ থেকে খুব দূর্বল হয়ে পরতাম। সারাদিন রোজা রেখে বিকেল হতেই বিচানায় শুয়ে পরতাম। পানীর পিপাসা লাগতো খুব। যখন খুব ছোট ছিলাম, ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি, তখন রোহানা ফুপুর মাটির চুলায় মিস্টি আলু পুড়ে আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে খেয়ে ফেলতাম। প্রায়ই ওজু করতে গিয়ে পানি খেয়ে ফেলতাম। ভাবতাম কেউ তো দেখছেনা!
রমজানের শেষের দিকটায় ঈদকার্ড কেনা ছিল দারুন আনন্দের। আগে থেকেই টাকা জমানো শুরু করতাম ঈদ কার্ড কিনতে। কার্ডে নানান রঙ্গের কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে ঈদ শুভেচ্ছা লিখে বন্ধুদের দিতাম। কিছু ঈদকার্ড ছিল মিউজিকসহ। কার্ড খুলতেই মিউজিক বাজতো।
শেষ রোজার দিন ঈদের চাঁদ দেখা মাত্রই বাড়ীতে শুরু হতো পিঠা ভাজার ধুম। সেই সাথে বড়আপু-ভাইয়াদের লাউড মিউজিকে চলতো গান। সকালে সেমাই রান্নার জন্য দুধ জালে বসানো হতো রাত থেকেই। নারিকেল কুড়ানো হতো। শেষ রোজায় তারাবী নামাজ পরতে হতোনা বলে দারুন খুশী লাগতো।
এভাবেই কেটেছে ছোটবেলার রমজান মাস। আজ সেইসব দিনগুলো ভাবলে কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায়। কতকিছু বদলে গেছে এতদিনে! কত আনন্দ বিলীন হয়ে গেছে! পুরণো রমজান মাস আজ আর ফিরে আসেনা!
HB Rita

Add to favorites
1,572 views