রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বনাম সুন্দরবন -
এইচ বি রিতা
Published on: আগস্ট 2, 2016
আমরা সকলেই জানি এবং মানি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো, সময়ের দাবি। আর এই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর প্রশ্নে কারও কোনো বিরোধিতা থাকার কথা নয়! তবে কেন বিরোধীতা হচ্ছে? মূলত বিরোধিতা রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নে নয়, বিরোধীতা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন সুরক্ষাকল্পে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানে!
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রামপালে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে পরিবেশের উপর।সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। খুলনা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশবিদরা একটি সমীক্ষা করে বলেন, “সুন্দরবন এলাকার বাতাসে ক্ষতিকারক সালফার ও নাইট্রোজেনের মাত্রা বর্তমানে প্রতি কিউবিক মিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম রয়েছে৷ বিদ্যুত্ কেন্দ্র হলে ঘনত্ব ৫৩.৪ মাইক্রোগ্রামে গিয়ে ঠেকবে৷ এর পরিণতি হিসেবে বিপন্ন হয়ে পড়বে সুন্দরবনের অস্তিত্ব৷ তাই এই বিদ্যুত্ কেন্দ্র হলে আমাদের লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হবে”।
ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দর বন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে। তবে অনেকেই এ নিয়ে বিতর্কিত সমীক্ষা দিয়ে বলছেন, সুন্দরবন থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আসলে ৯ কিমি দূরত্বে স্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্বের অনন্য দেশগুলোকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সাধারণত তারা সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২০ কিমি এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেন না। কারণ এতে বিদ্যুত্ কেন্দ্রের ছাই ও ধোয়া সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ব্যাপক ক্ষতি করে এবং আশেপাশের জীবজন্তুদের জন্য ও এটা হুমকি স্বরুপ। আরো একটি বিতর্কিত বিষয় হলো, ভারতের ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান অ্যাক্ট ১৯৭২ এ উল্লেখিত, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে, কোন বাঘ-হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈব বৈচিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্যকোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। সুতরাং ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি, বাংলাদেশে সুন্দরবনের যতটা কাছে পরিবেশ ধ্বংস কারী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছেন, সে একি কাজ তার নিজ দেশ ভারতে হলে, কখনোই সেটা বাস্তনায়ন হতনা। অনেকেই হয়তো জানেন, ২০১১ সালে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকাকুলাম জেলায় একটি কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র অর্থাৎ থার্মাল পাওয়াল প্ল্যান্ট নির্মাণ করতে গেলে, এলাকাবাসীর তীব্র প্রতিরোধের সম্মূখীন হয়েছিলো ভারত সরকার।
প্রাসঙ্গিকভাবে আরো উল্লেখ করা যায়, ভারতের এনটিপিসি কোম্পানি ছত্তিশগড়ে একই প্রকল্প অর্থাৎ একটি ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গ্রিন প্যানেলের ইআইএ রিপোর্ট প্রকল্পটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং ভারত সরকার সেই প্রকল্পটি বাতিল করেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, যে প্রকল্পটি তার জন্মভূমি ভারতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হলো, সেটি আমাদের দেশে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেল কীভাবে?
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মোট খরচের পরিমান ধরা হয়েছে ২০১ কোটি ডলার। এর ৭০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ নেয়া হবে,অর্থাৎ ৭০ ভাগ ঋণ ও ঋণের সুদ বাংলাদেশকেই পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৩০ শতাংশের মাঝে ১৫ শতাংশ অর্থ দেবে পিডিবি এবং ১৫ শতাংশ দেবে ভারতের এনটিপিসি। প্রকল্পটির জন্য পুরো জমি সরবরাহ করবে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী কয়লা আমদানির দায়িত্ব বাংলাদেশের এবং ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার ও বাংলাদেশেরই। কিন্তু মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে এই প্রকল্প থেকে যে নিট লাভ হবে, তার অর্ধেক নিয়ে নেবে ভারত, অর্ধেক বাংলাদেশ। এছাড়াও এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনতে হবে পিডিবিকে। তাহলে কি দাঁড়ালো? মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটির মালিকানা নিয়ে নেবে ভারত।
নিয়মানুযায়ী সুন্দরবনের জন্য “পরিবেশগত স্পর্শকাতর” মানদণ্ড উল্লেখ করার কথা থাকলেও, ইআইএ রিপোর্টে অত্যন্ত সুকৌশলে সুন্দরবনের জন্য ‘আবাসিক ও গ্রাম’ এলাকার মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে! কারণ কি? কারণটি হলো- ইআইএ রিপোর্ট অনুযায়ী,রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড যা কিনা বছরে ৫১ হাজার ৮৩০ টন এবং ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড যা বছরে ৩১ হাজার ২৫ টন নির্গত হবে। এই বিশাল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে। ফলে ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়বে সুন্দরবনের পরিবেশ। আর তাই পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ নির্ধারিত সীমার মধ্যে এর মাত্রা দেখানোর জন্যই ইআইএ রিপোর্টে “পরিবেশগত স্পর্শকাতর” এলাকার মানদন্ডের বদলে, সুন্দরবনের জন্য “আবাসিক ও গ্রাম” এলাকার মানদন্ড বেছে নেয়া হয়েছে!
এবার দেখা যাক রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা কি বলছেন!
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড.আবদুস সাত্তার এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড.আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিবেশবিদদের একটি দল প্রস্তাবিত রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ওপর পৃথক ভাবে গবেষণা করে। তারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে ন্যূনতম ২৩ ধরনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে ধরেন। যেসব বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটা বিষয় ঊল্লেখ্য করা হলো-
– সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র নষ্ট হবে, শুরু হবে অবাধে গাছ কাটা, লাগানো হবে বনে আগুন, ধরা পড়বে বাঘ-হরিণ-কুমির।
– কয়লা পোড়া সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড,ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের জৈবিক পরিবেশ ও বায়ুমণ্ডলকে খতিগ্রস্থ করবে।
– ঐ এলাকার কৃষিপণ্য খেলে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়বে অ্যাজমা, ফুসফুসবাহিত নানা রোগ, এমনকি ক্যন্সারের সম্ভাবনাও থাকবে।
– বায়ু ও শব্দ দূষণ
– তাপমাত্রা বাড়বে,বৃষ্টিপাত কমতে পারে ও এসিড বৃষ্টি হতে পারে।
– ভু-পৃষ্ঠের পরিবর্তন অত্যাদিক মাত্রায় হতে পারে।
– সুন্দরবন ও তার সন্নিহিত গ্রাম অঞ্চলে প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পদ এর মারাত্মক হ্রাস।
– জীব বৈচিত্র হ্রাস ও ধ্বংস হবে।
– বন্য জীব বিনাশ, পালিত মৎস্য সম্পদ এর ক্ষতি
[[ সুন্দরবনের কাছে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব আরো বিস্তারিত জানতে,অনলাইনে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের আর্টিক্যাল পড়তে পারেন]]
অবশেষে একটি কথাই বলবো, আমরা সাধারণ মানুষরা দেশের শত্রু নই। দেশের সার্বিক উন্নয়নে আমাদের বিরোধীতা করার প্রশ্ন, অমূলক। বিদ্যুৎ ঘাটতি আমাদের দেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে, পরিবেশের ওপর আঘাত আনা এবং জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে করে রাষ্ট্রকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলা, কোনভাবেই কাম্য নয়। সুন্দরবন রক্ষায়,রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি দেশের অন্য কোন নিরাপদ জায়গায় বাস্তবায়ন করা হোক!

Add to favorites
1,015 views