২০১৬ উল্লেখ্যযোগ্য কিছু হত্যাকান্ড -
এইচ বি রিতা
Published on: মার্চ 16, 2017
নয় মাসের উপর হয়ে গেল, কিন্তু এখনো উৎঘাটন হয়নি মিতু হত্যার রহস্য।
দুই সন্তানের মা মিতুকে গত ৫ জুন চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় তার বাসার নিকট কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়।
জানা গেছে, দুই হত্যাকারীসহ পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে, যারা সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। দুইজন পুলিসের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত। প্রধান সন্দেহভাজন আসামি কামরুল ইসলাম মুসা ওরফে মুসা সিকদার এখনও পলাতক। তবে মুসার স্ত্রী পান্না আখতারের অভিযোগ, গত ২২ জুন সাদা পোশাকের পুলিশ মুসাকে গ্রেফতার করেছে।
প্রশ্ন- মুসা তাহলে কোথায়?
মিতু হত্যার পর আমাদের মিডিয়ার চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী পত্রিকায় বড় বড় হরফে ছাপিয়ে দেয়া হয় যে চট্টগ্রামের জনৈক ব্যবসায়ীর সাথে মিতুর পরকিয়ার সম্পর্ক ছিল। এতে করে অনেকেই ধারণা করতে থাকেন যে ব্যাভিচারী মিতুর পরকিয়ার জের ধরেই হয়তো তাকে হত্যা করা হয়েছে।
নানা নাটক আর চড়াই-উতড়াইয়ের পর অবশেষে আরো কিছু বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ হতে শুরু করেছে চট্টগ্রামে গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকান্ড মাহমুদা খানম মিতুর হত্যারকান্ড।
সকল ধারণার অবসান ঘটিয়ে মিতু হত্যাকান্ড নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করালেন পুলিশের সাবেক উপ-পরিদর্শক আকরাম হোসেনের বোন জান্নাত আরা পারভীন রিনি। তার দাবী, মিতু হত্যাকাণ্ড এবং আকরাম হত্যাকান্ড এক সূত্রে গাঁথা। দু’জনই পরকীয়ার জন্য খুন হয়েছে। তবে এ পরকীয়া আকরাম হোসেন ও মিতুর মধ্যে নয়; এ পরকীয়া আকরাম হোসেনের স্ত্রী বর্ণি ও মিতুর স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের মধ্যে। রিমির দাবী, পরকীয়ার জের ধরে ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর আকরামকে পরিকল্পিতভাবে হামলা করে করে বাবুল আক্তার ও বর্ণি। হত্যা করার জন্যই আকরামকে যমুনা সেতু হয়ে ঝিনাইদহ আসার পরামর্শ দেয় বর্ণি। পথে তাকে সন্ত্রাসী দিয়ে হামলা করে আহত করে। ঢাকায় চিকিৎসা নিয়ে আকরামের অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল, কিন্তু বর্ণি স্যুপে বিষ মিশিয়ে খাওয়ালে ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি আকরাম মারা যান। আকরাম মারা যাবার পর আদালতে দায়ের করা মামলায় বাবুল আক্তারের নাম দিতে চেয়েছিলেন তার পরিবার। কিন্তু ঝিনাইদহের তৎকালীন এসপি আলতাফ হোসেনের চাপে বাবুলের নাম দিতে পারেননি তারা।
এদিকে মিতুর পরিবার এতদিন মুখ না খুললেও, রিমির দায়েরকৃত অভিযোগের পর, মিতুর বাবা মোশারফ হোসেন ও মা
সাহেদা মোশাররফও তদন্ত কর্ম-কর্তাদের কাছে মুখ খুলেছেন। মিতুর মা সাহেদা মোশারফ জানান, বাবুল আক্তার মিতুর সঙ্গে আগে থেকেই ভাল আচরণ করত না। কিন্তু মিতু মারা যাওয়ার ৫-৭ দিন আগে হঠাৎ ভাল আচরণ করা শুরু করে। মিতু তখন তার মাকে বলছিল,
“মা আমার সন্দেহ লাগছে, হঠাৎ করে বাবুলের আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেল কেন। তার মোটিভটা ভাল লাগছে না।”
তিনি আরো জানান, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোনে মিতু আপত্তিকর কিছু এসএমএস দেখতে পান। সেখানে গায়েত্রী এম্মারর্সিং নামের এক ভারতীয় নারীর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের তথ্য জানতে পারেন মিতু। এ নিয়ে বাবুল আক্তারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শুরু হয় দুজনের মধ্যে। সাহেদা মোশারফ বলেন, “মেয়ে খুনের পর আমরা বাসা থেকে তার জিনিসপত্র ঢাকায় নিয়ে আসি। সেখানে মিতুর ছেলের স্কুলের আর্ট পেপারে ইংরেজি লেখা দেখতে পাই। লেখাগুলো মিতুর হাতের। পড়ে দেখি যে ঐসব মেসেজ বাবু’র (বাবুল আক্তার) মোবাইল ফোনে ভারতীয় নারী গায়ত্রী পাঠিয়েছিল।বাবুর মোবাইল ফোনে ঐসব মেসেজ দেখে মেয়ে আমার কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,
“মা আমি এখন কী করব?” তখন আমি বলেছিলাম,
“কী করবি মা, মেয়ে মানুষের বিয়ে একবারই হয়। ধরে নিলাম তুই মরে গেছিস। এখন স্বামীর ঘরে কষ্ট করে থাক।”
তদন্ত কর্ম-কর্তাদের প্রশ্নের মুখে মিতুর বাবা মোশারফ হোসেন বলেন, “বাবুল আক্তার, তার বোন, মা-বাবা মিতুর উপর নির্যাতন করত। মিতু এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে চট্টগ্রাম থেকে আমার বাসায় চলে আসতে চেয়েছিল। এটার সাক্ষী ওদের বাসার কাজের মেয়ে। কিন্তু ওরা আসতে দেয় নাই। ওরা তাকে থামায় রাখছে। এরপর মিতু আত্মহত্যার চেষ্টা করে।”
মিতু হত্যার রহস্য দিন দিন ঘোলাটে হচ্ছে। সময়ের সাথে নতুন নতুন তথ্য বেড়িয়ে আসছে। কিন্তু সমাধান কবে হবে? আসল খুনীর হদিস পুলিশ কবে পাবে? মিডিয়ার জবাবে পুলিশ বার বার বলছেন ” আন্ডার ইনভেসটিগেশন!” যেমনটা বলছেন তারা অন্জলী দেবীর বেলায়। আপনাদের কি অন্জলী দেবীকে মনে আছে?
২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের সিনিয়র শিক্ষিকা অঞ্জলী দেবীকে চকবাজার তেলিপট্টি মোড়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় অঞ্জলী দেবীর স্বামী ডা. রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী পাঁচলাইশ থানায় ১০ জানুয়ারি রাতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে মুখোশধারী অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনায় সম্পৃক্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও, নার্সিং কলেজে হিজাব পরা নিয়ে আন্দোলনের জের ধরে এ ঘটনা ঘটতে পারে সন্দেহে ঘটনার ৬ মাস পর গত বছরের ১৪ জুন মো. রেজা নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েও কোনো তথ্য বের করতে পারেনি গোয়েন্দা পুলিশ। দীর্ঘদিনেও খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় অঞ্জলীর স্বজনেরা হতাশ হয়ে বিচারের দাবি ও আশা ছেড়ে দিয়েছেন। যেমনটা ছেড়ে দিয়েছেন তনুর বাবা-মা।
২০১৬ ছিল আতংকের মাস।
– মার্চ মাসের ২০ তারিখে কুমিল্লা সেনানিবাসের ভিতরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী, নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। সেনানিবাসের মতো একটি নিরাপদ স্থানে তনুকে কে বা কারা হত্যা করল তা এখনও বের করা সম্ভব হয়নি। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে বিভ্রান্তি, মামলার তদন্তে ধীরগতি, প্রশাশনের নজর আন্দাজ, সব মিলিয়ে কারো বুঝতে বাকি নেই যে তনুর ঘাতকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। প্রশাসন তনু হত্যা মামলায় কাকে আড়াল করতে চাইছেন, তা সকলের জানা।
– বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আগস্ট মাসের সূচনালগ্নে রাত ১২টা ১ মিনিটে মোমবাতি প্রজ্বলনের কর্মসূচি শেষে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে, ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সাইফুল্লাহ। নিরপরাধ সাইফুল্লার হত্যাকারীরা ছিল ছাত্রলীগের সদস্য। কেউ কি বলতে পারেন সাইফুল্লাহ হত্যার বিচার কেন হয়নি?
– মাসের শুরুর দিনে কুমিল্লায় ছাত্র-হত্যার ঘটনার পর একই মাসের ১৩ তারিখ বিকেলে মিরপুরে আল হেলাল হাসপাতালে, রাজধানীর মিরপুরের সাইক ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলোজির স্থাপত্য বিদ্যার চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আফসানা ফেরদৌসকে মৃত ফেলে রেখে যায় দুই যুবক। ঘটনা তদন্তে নাম উঠে আসে তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবীনের নাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, রবীনের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
একটি বিষয় পরিস্কার করতে চাচ্ছি, কোন দলকে হেয় করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বর্তমান সোনার বাংলায় “মানুষ মারা” কত সহজলভ্য আমি কেবল তাই বোঝাতে চাইছি। ক্ষমতর দাপটে অপরাধ করে ও স্বাধীন বাংলার সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে অপরাধীরা। আর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কে? তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। হ্যা, আমরা দেখি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন বাংলাদেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে বিশ্বের দরবারে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে। এমন প্রচেষ্টাকে সালাম। কিন্তু আমরা সেটাও নজর আন্দাজ করতে পারিনা যে, তাঁর সমর্থক হিসেবে পরিচয়দানকারী রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা ঠিক তার উল্টো কাজ করে যাচ্ছেন এবং তাদের অপরাধ দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না। অপরাদ দমনে জরুরী আইন, কড়া নিরাপত্তা জারি আছে; তবে তা কেবল ভিন্ন মতাদর্শদের জন্য।
রাষ্ট্রীয় অনাচারে সমাজ প্রশ্নবিদ্ধ না হলেও, সামাজিক অনাচারে রাষ্ট্র সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। অন্জলী দেবী ও সাইফুল্লার পাশাপাশি তনু-আফসানা-মিতু…. বছরের এই তিনটি আলোচিত হত্যার ঠিক পরপরই সুপষ্ট প্রমানাদি থাকা না সত্বেও মিডিয়া এই তিন নারীর চরিত্ব নিয়ে কথা তুলে। মিডিয়ার পাশাপাশি আমরা সচেতন নাগরিকরাও তাদের লাশ নিয়ে কম টানা-হেচরা করিনি। নারীর সন্মান রক্ষার্থে আমরা কতটুকু সচেতন, তা আপেক্ষিক; তবে সুযোগ পেলেই নারীকে দলামুচরা করে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে আমাদের জুড়ি নেই। কোন নারী হত্যা হলে আমরা সবার আগে সে নারীর ব্যক্তিগত জীবন-যাপন নিয়ে তালাশ শুরু করি। সে কি পরকীয়ায় জড়িত ছিল কিনা, তার কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল কিনা…ইত্যাদি। কোন ছুতো খুঁজে না পেলে মনগড়া লেভেল সিল মেরে দেই। এই হচ্ছে আমাদের স্বভাব। মানলাম, তনু-মিতু-আফসানাদের চরিত্র ভাল ছিলনা। তো? তাদের ব্যক্তিগত চরিত্র খারাপ বলেই তাদের হত্যা করা ফরজ? তাদের অপমৃত্যু স্বাভাবিক? এমন ভাবার অধীকার আপনাকে কে দিয়েছে? যখন কোন মেয়ের পরিত্যক্ত লাশ উদ্ধার করা হয় নালা-ডোবার পাশ থেকে, তখন আপনি বলেন, “বেশ হয়েছে, মেয়ে নস্ট কাজ করতে গেল কেন?” কিন্তু সেই আপনিই যখন আপনার প্রেমিকাকে বন্ধুর ফ্ল্যাটে নগ্ন করে ভোগ করেন, তখন ওই নগ্ন প্রেমিকা হয়ে উঠে আপনার কাছে ব্যাবিডল কিংবা সেক্সি চিক। ওহ ম্যান!!! প্লিজ!!
বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর অধীকার সম্পর্কে আইন থাকলেও, নারীর সম্ভ্রম ও মর্যাদা রক্ষায় কোন আইন বা সিকিউরিটি নেই।
২০১১ সালে সংশোধীত জাতীয় নারী নীতি আইনের ২৪ পৃষ্ঠার নীতিমালা মোট ৩ টি ভাগে ৪৯টি ধারায় বিভক্ত। বিশদ আলোচনায় যাবোনা, সংশোধীত জাতীয় নারী নীতি আইনে, নারী ও আইন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারী মানবসম্পদ, নারী-রাজনীতি ও প্রশাসন, জাতীয় নারী উন্নয়নের লক্ষ্য, নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, নারীর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন দূরীকরণ, শিক্ষা ও প্রশাসনে নারী, ক্রিড়া ও সংস্কৃতিতে নারী, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারীর কর্মসংস্থান, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন, নারী-উন্নয়নে এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনের সাথে সহযোগিতা, নারীর ক্ষমতায়নেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রভৃতিকে আওতাভুক্ত করা হয়। লক্ষ্য করে দেখুন, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যা দ্বারা কেবল নারীর শারীরিক নির্যাতনকে টার্গেট করা হয়েছে; নারীর জন্য ভারভল ও ইমোশনাল নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেই। নারীর মানবিক ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। তবে কি নারীর সম্ভ্রম ও পরিচয় অক্ষুন্ন রাখা, মৌলিক অধীকার ও স্বাধীনতার বহির্ভূত?
বাংলাদেশ সংবিধানে নারীর জন্য নতুন একটি আইন প্রণয়ন খুব জরুরী- জীবিত কিংবা মৃত, যে কোন অবস্থায়, কোন নারীর ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করা, আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।
কেবল ২০১৬ নয়, প্রতিদিন ঘটে যাওয়া নারী হত্যার বিচার চাই।

Add to favorites
731 views