শুভদা-১ -
এইচ বি রিতা
Published on: জানুয়ারী 1, 2013
রাতভর চোখের পাতা এক করতে পারিনি। বার বার শুভদার মুখটা চোখে ভাসছে। আজ এতটা বছর পর………….! কি জানি একটা অশুভ সংকেত হৃদয়ে শব্দ করে ঘন্টা বাজিয়ে যাচ্ছে। বাইরে মুষল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কপাটটা খোলা। দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টির ফোটা গুলো ভিতরে এসে মেঝেটা ভিজিয়ে দিচ্ছে।
নড়তে ইচ্ছে করছেনা। ভিজুক। আজ সব ভিজে যাক। প্রকৃতি আজ বৃষ্টির পানিতে আমার সব কলংক ধুয়ে মুছে দিক। ভিজিয়ে সিক্ত করে দিক আমার যন্ত্রণা। সেই ১৯ টি বছর যে নরক যন্ত্রণা পুষে রেখেছি বন্দি খাচায়, তার দুয়ার আজ কেও খুলে দিক। উড়ে যাক সব অনুশোচনা, ধুয়ে যাক সব পাপ! আজ ১৯ টি বছর পর শুভদা কেন ফিরে এলো?
সেই পুরোনো ঝড়টা বুঝি আবার ফিরে এলো আমার সাজানো বাগান তচনচ করে দিতে। চোখের পাতায় ক্লান্তি নামছে। ঘুম পাড়ানির মা যে আজ কোথায় চলে গেলো! আহ! আজ বড় ক্লান্ত লাগছে। বুয়া নাক ডেকে পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে। অতশী আজো সেই ছোট্ট মেয়েটির মত তার বাবার পাশে এক কাত হয়ে জড়োসরো ঘুমাচ্ছে।
আলসেমীর সুখে ছেঁদ কাটিয়ে উঠে দাড়ালাম। এক কাপ লেবু চা হলে ভাল হয়। ক্লান্তি কিছুটা দূর হবে। রান্না ঘরে বাতি জ্বালাতেই জলজলে চোখে কালো বিড়ালটা দৌড়ে পালালো। বুকটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠল। আজ এমন হচ্ছে কেন? সব কেমন অশুভ ঠেকছে! তাহলে কি আমার জন্য ভয়ংকর কিচ্ছু অপেক্ষা করছে! নাহ! আর ভাবতে পারছিনা। মাথাটা এবার সত্যি চিনচিন করে উঠছে। চা টা হলে ভাল হয়।
কেটলীটা চুলায় চড়ালাম। নিজ হাতে চা বানিয়ে মাঝরাতে খাওয়ার সাধই অন্য রকম। চা’টা ছেঁকে আবারাও সেই আগের ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলাম। চায়ে চুমুক এর সাথে সাথেই ক্লান্তি অনেকটা কমে গেল। আর সেই সাথে যেন স্মৃতিগুলো স্পস্ট থেকে স্পস্টতর হয়ে উঠছে! ক্লান্তিবোধ কি তাহলে মানুষের চিন্তা চেতনাকে গতিহীন করে দেয়? কে জানে, হয়তো!
শুভদা আজ কেন এত তাড়া করছে আমায়? এতটা দিন পর আজ কেন আমায় খুঁজে পেতে হল? আজ কি ভেবে তার মন এত উতলা হল? তাহলে কি সেই পুরোণো হিসেব নিকেশ কষতে ফিরে আসা? না না…. এসব কি ভাবছি আমি! শুভদা কথা দিয়েছিল কখনো ফিরে ডাকবেনা।
এখনো স্পস্ট মনে আছে….সেই মাঘের কুয়াশায় ডাকা ভোরে শুভদার ঘরে গিয়েছিলাম। কিছু ভয়, কিছু লজ্জ্বা রাঙা কম্পিত ওষ্ঠে বলেছিলাম …..
-শুভদা, তুমি চলে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব?
শুভদা দু’হাত বাড়িয়ে আমার মুখাটি চেপে ধরে কেঁদেছিল। বলেছিল,
-পাগলী! তুই এমন করলে কি আমি যেতে পারি?
-জানিনা শুভদা! তোমায় বড্ড ভালবাসি। এটুকুই জানি।
শুভদা আমায় বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল। বলেছিলাম,
-যদি আর কখনো না ফিরো! যদি আর তোমার দেখা না পাই?আমি মরে যাব শুভদা। যাওয়ার আগে কিছু তো রেখে যাও, কিছু একটা বলে যাও!
শুভদা বলেছিল,
-তুই আমার একটাই পাগলী, তুরে রেখে পালাবো কোথায়?
শুভদা আমায় পরম স্নেহে, আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর কি হল জানিনা। আমি হাড়িয়ে গিয়েছিলাম এক অজানা স্রোতে। পালবিহীন নৌকা ভাসিয়েছিলাম অজানার পথে; শুধু আমি আর শুভদা! শুভদাতে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম সেই শীতের ভোরে। কূয়াশাদানার মত শুভদা আমায় সিক্ত করে দিয়েছিল সেই ভোরে। আমি ও কি চাইনি? সবটা কি শুধু তারই চাওয়া ছিল?
পরদিন শুভদা উচ্চ-শিক্ষার জন্য চলে গিয়েছিল কলকাতা। আর ফিরে আসেনি। কত দিন গেল, কত রাত গেল, শুভদা এলনা। বাবা তার সন্মান হারাতে চাইলনা। অতশীর বাবার অস্তিত্বে সিঁদ কেটে তড়িঘরি আমায় ঢুকিয়ে ছিটকিনি এঁটে দিল। কত বড় অনাকাঙ্খিত প্রতারণায় তাকে জড়িয়ে রইলাম, মানুষটা টেরই পেলনা। আজ যাকে পরম যত্নে বুকে জড়িয়ে ঘুমুচ্ছে, সে তার রক্তকনিকা থেকে সৃষ্ট নয়! সে অন্য কারো দ্বারা সৃষ্টি!
কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই আচমকা চমকে পিছন ফিরি। অতশী চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে। ভোরের প্রথম চা আমার মেয়ের হাতে! আহ! কি যে সুখের! স্নিগ্ধ পবিত্র মুখখানি ঠিক শুভদার মত। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি, বুকটা দুমড়ে-মুচরে কেঁদে উঠে। ১৯ বছর ধরে গোপনে বেড়ে উঠা আমার এক টুকরো সুখ অতশী, কঠিন সত্যের মুখোমুখী হলে হারিয়ে না যায়!
পাপ! সে তো সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়ে মনের ভিতর! তারপর ক্যান্সার প্রক্রিয়ায় বিঁষ ছড়ায় দেহে। তবে কি এক রাতের পাপই আমাকে আজ ১৯টা বছর কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে? যদি তা পাপই হয়, তবে ভালবাসার স্থান কোথায়? পাপ তবে কোনটা ছিল! শুভদার কাছে আত্মসমর্পন? অতশী? নাকি মুখোশের আড়ালে ভয়ানক অন্ধকার ঢেকে আজকের মানুষটাকে সুখী করা?
সত্যের মুখোমুখী হতে আমার বড় ভয়! অতশী আমার। অতশী ওই বুকে জড়িয়ে বেড়ে উঠা নিষ্পাপ মানুষটির। এখানে শুভদার কোন স্থান নেই; কোন পরিচয় নেই।
শুভদা! তুমি চলে যাও দূরে। যে পথের বাঁকে কেবল ধূলিমাখা বিরহ, তুমি হেঁটে যাও সে পথে। আমার খোঁজ করোনা তুমি। সব ভেসে যাবে! যে হ্নদয়ে অনন্ত বিরহ জ্বলে, সেখানেই থাকো তুমি। তুমি পর্দার আড়ালে থাকো।

Add to favorites
1,385 views