আমি এক নিঁখোজ বাংলাদেশী -
এইচ বি রিতা
Published on: জুলাই 5, 2016
যখন দেশ ছাড়ি, তখন আমি এক উড়ন্ত কিশোরী। আবেগ ছিল, আবেগের সীমারেখা ছিলনা। যদিও এমেরিকা আমার স্বপ্নের দেশ ছিলনা, তবু এসেই পড়লাম। তবে আমার আসাটা ছিল ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন কারণে।
এখানে এসেই খুব হতাশ হয়ে গেলাম। সারাক্ষন ঘরে আটকে থাকা। বাহিরে গেলে যাদের দেখি তারা সব ঠাস ঠাস ইংরেজী বলে। সাধারণ ইংরেজীগুলো বুঝতে পারলেও এমেরিকান ফ্রেইজ ব্যবহার করা বাক্যগুলো একেবারেই বুজতামনা। সব কেমন মেকি মেকি।বিদেশী মানুষগুলো কথার থেকে চোখ-মুখ-হাতের অঙ্গভঙ্গি বেশী করে। কেমন যেন অকৃত্রিম। জ্যাকসন হাইটস ও জামাইকা না গেলে কোন বাঙ্গালীর দেখা মিলতনা। দেশে ফোনকলে কথা বলার জন্য তখন ফোনকার্ড ছিলনা। এস্টোরিয়াতে একজন বাঙ্গালীর দোকানে গিয়ে লাইন দিতে হতো ঘন্টা ধরে। ছোট ছোট খুপটিতে ফোন থাকতো। ৫০ সেন্টস মিনিট হিসাবে কথা বলতাম দেশে। কথা শেষে পরবর্তী তারিখ জানিয়ে দিতাম ফোন করার। বলে দিতাম সবাই যেন ফোনের সামনে থাকে।
কি ভীষণ মন খারাপ নিয়ে ভাবতাম দেশের কথা, প্রিয় মানুষগুলোর কথা, বাড়ীর ফটকে রাত পাহাড়ায় বসে থাকা কুকুরটির কথা! প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। সপ্তাহ শেষে সব এক সাথে পাঠাতাম প্রিয মানুষগুলোকে।
তারপর একদিন, কচুরীপানার মতই সময়ের সাথে ভাসতে ভাসতে নিজের ভিতর আবিস্কার করলাম ভিন্ন এক আমিকে। পড়াশুনা শুরু করলাম। প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন আমাকে পেয়ে বসলো। গ্র্যাজুয়েশন করলাম ম্যাগনা কাম রাওডি এওয়ার্ড নিয়ে। গ্র্যাজুয়েট স্কুলে গেলাম আরো উপরে উঠব বলে। ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশনে চাকরী হল। জীবনধারা বদলে গেল। একটা জীবন পিছনে ফেলে নতুন জীবনের স্বাদ পেলাম। ১৯টি বছর কেটে গেল এমেরিকার মাটিতে।
আজ যখন কেউ বলে, বিদেশ আর কতদিন! এবার দেশে চলে আয়, তখন মনে হয়, দেশে যাব? এমন বেতন, এমন সুবিধা কি সেখানে পাবো? মশার যা উৎপাত! লোডশ্যাডিং সহ্য হবে তো? যে হারে রোড এক্সিডেন্ট ঘটে, জীবনের নিশ্চয়তা কই? যা ভেজাল সব খাবার ওদেশে! অর্গানিক খাবার তো পাবোনা! আমার নিউরোপ্যাথিক ডিসঅর্ডার নির্ঘাত বেড়ে যাবে তাহলে! তারউপর অনুন্নত চিকিৎসা! না বাবা! থাক! বছরে দু’বার বেড়াতে যাই সেই যথেষ্ট!
শৈশবের সেই নানু বাড়ীর লাল মাটির ঘর এখন আমার কাছে কেবল বেদনাবিধুর স্মৃতি। গাছ পাকা কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া, উঠোন জুড়ে দাদীমার শখের পাকা ধানের গন্ধ, লোডশ্যাডিংয়ে তাল পাতার পাখার বাতাস,
টিউবে নদী সাঁতরে এপার হতে ওপার যাওয়া কেবল অতীত। ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে ছুটোছুটি করা, বৃষ্টিতে গোসল, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে ধ্যানমগ্নতা, জোৎস্না রাতে ছাদের কার্নিশে পা ঝুলিয়ে ভাবনায় হারিয়ে যাওয়া, রিকশায় চড়ে আইসক্রীম খাওয়া… কেবলই স্মৃতি।
এখন ভালো লাগে রোজভ্যাল্ট আইল্যান্ড। ভালো লাগে রকওয়ে বিচ, কনি আইল্যান্ড। এখানের আকাশে কোন রং নেই, তবু ভাল লাগে! বিশুদ্ধ বাতাস, পরিচ্ছন্ন পথ, নিশ্চিত জীবন, চাকরীর নিরাপত্তা, উন্নত চিকিৎসা সবই উপভোগ করি! নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে এখন সবকিছুই মেনে নিয়েছি।
মাঝে মাঝে যখন স্মৃতির পাতা খুলে বসি একাকী-নিভৃতে, তখন মনে হয়, আমি কে? আমি কি একজন বাংলাদেশী? নাকি এমেরিকান? জন্মসূত্র আগে? নাকি নাগরিকত্ব?
অবশেষে জেনে যাই আমার পরিচয়। আমি এক নিঁখোজ বাংলাদেশী।

Add to favorites
850 views