আমি নসিমনঃ ০২. পোকা -
এইচ বি রিতা
Published on: সেপ্টেম্বর 9, 2017
মাথার অসুখটা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অসুখ নিয়ে সুখের নাগাল অসম্ভব। অসুখটার কি নাম দেয়া যায়? ঘুন পোকা অসুখ? অসুখটা ঘুন পোকাদের মত মগজ গর্ত করে একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। মগজের ক্ষতি সাধন করছে রোজ একটু একটু করে। শর্করাযুক্ত অংশটুকু খাচ্ছে চেটেপুটে। বিনা নোটিশে হুটহাট মাঝ রাতে অসুখটা বেড়িয়ে আসে টিপ টিপ পায়ে! তখন ১ মিলিমিটার প্রশস্ত গর্ত করে দেয় আমার মগজে। অসহ্য ব্যাথায় তারপর সেই গর্তে শূন্যস্থান পূরণে কিলকিল করে অসংখ্য উদ্ভট চিন্তা! অসুখটা মগজে গর্ত খুঁড়ে বেড়িয়ে এলেই আমি ভিন্ন মানুষ! আলো থেকে দূরে, বাস্তবতা থেকে দুরে। তখন আমি অন্য কেউ। অসুখটা মগজের বিনাশ করছে। টের পাই। কিছু করার নেই।
অসুখটা বেড়িয়ে এলেই মনে হয়, এই যে ঈশ্বরের নামে এত উপাসনা, এত সমযোতা, এত ব্যাকুলতা, তাহলে সেই ঈশ্বরকে আমরা দেখিনা কেন? গীতার লাইনটি বার বার কানে বাজে। “অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।” তবে কি মায়া বা অহং আকাশের মেঘস্বরুপ? মেঘ সরে গেলেই যেমন সূর্য্যের দেখা পাই, মন থেকে অহংবুদ্ধি সরে গেলেই কি তবে ঈশ্বরদর্শন হবে?
এ তো সহজ নয়! আমিত্বকে কি করে সরানো যায়? আর মায়া? আমিত্ববোধের পাশেই তো মায়ার বাস! ঈশ্বর তবে আমার “আমি”কে জানার জ্ঞান দিলেন কেন? মায়া বাঁধা সংসার দিলেন কেন? এত প্রতিবন্ধকতা পেড়িয়ে ঈশ্বরদর্শন সহজ কি?
বুঝিনা! বুঝিনা! ক্ষুদ্র জ্ঞানে বেশী দূর এগুতে পারিনা। জ্ঞান খেয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত ঘুন পোকা অসুখ!
পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যের মাঝে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দর। অথচ মানুষকে এই “মানুষ” হতে সাধনা করতে হয়। সাধনাহীন মানুষ পশু! মানুষ আর পশু চেনার উপায় কি? আকার, আকৃতি, অবস্থান সব তো এক।
দাদীমা বলতেন, আত্ম বৈশিষ্ট্য নয়, বিচক্ষন অন্তদৃষ্টি ও মস্তিষ্ক দিয়ে মানুষকে বুঝার চেষ্টা করবি। তবেই মানুষ চিনবি। অন্তদৃষ্টি যদি নির্ভর করে মস্তিষ্কের বিচার ক্ষমতার উপর, তবে আদৌ আমার মানুষ চেনা হবেনা। আমার মস্তিষ্ক খেয়ে যাচ্ছে ঘুন পোকা অসুখ!
পৃথিবীর মানুষ গুলো বড় অদ্ভুত! তার থেকেও অদ্ভুত তার গতিবিধি। মানুষের মাঝেই যত রহস্য, যত জটিলতা-অস্বাভাবিকতা! প্রায়ই ভাবি! ভেবে ভেবে চশমাটায় ধুলী জমে। ভেবে ভেবে কুঁমড়ো মাঁচায় ফুল থেকে জীবন বাড়ে। ভেবে ভেবে আঙুল সমান কড়ুই গাছটার তলে সুর্য্য ঢলে পরে। ভেবে ভেবে গোছা গোছা রেশ্মী কালো চুলে শুভ্র মেঘদুত খেলা করে যায়। ভেবে ভেবে দুই পা থেকে চার পা-ছয় পা বাড়ে, তবুও মানুষের স্বরুপ চেনা হয়না! রহস্য উন্মোচন হয়না!
সারাটা জীবন মানুষের মাঝে বিভক্ত মানুষ খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছি। বিভক্ত মানুষের খুঁজে অমানুষ হয়েছি কতবার! তারপরই জানলাম, খালি চোখে যা দৃশ্যমান, তা সত্য নয়। সত্যের আড়ালে মানুষ ধারণ করে অগনিত মিথ্যা! কখনো সেটা নিজের প্রয়োজনে, কখনো স্বভাবগত কারণে। মানুষগুলো বোঝেনা, একদিন পৃথিবীর সকল অনাচার ধ্বংস হবে। মানুষ ধ্বংস হবে! কষ্ট বলে কোন নিরাকার বস্তু বা বায়বীয় স্পর্শ থাকবেনা পৃথিবীতে। যা থাকবে, তা কেবল কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন।
তারপরই মনে হয়, আমি কি নিজেকে খুব চিনি? আমার “আমিত্ববোধ”কেই এখনো চেনা হয়নি। আমি জানিনা আমি কে!
জগতের প্রতিটি সত্তার আমিত্ববোধ ক্রিয়াশীল। যদি জড় ও জীবের আমিত্ববোধের পার্থক্য নির্ণয় হয় পরিমানগত, রূপগত ও গুনগত বৈশিষ্টে, যদি আমিত্ববোধ ছাড়া স্বত্তার কোন অস্তিত্ব না থাকে, তবে আমার ও অস্তিত্ব নেই। কিংবা এমনও হতে পারে, আমিত্ববোধ বিলুপ্তির কারণে আমার অস্তিত্বের বিনাশ ঘটেছে! অসম্ভব নয়। একক সত্তা কখনো কখনো বহু সত্তায় বিভক্ত হয়ে বহু আমিত্ববোধের সৃষ্টি করে। আর সেই একক সত্তার বিভক্তির সাথে সত্তার আমিত্ববোধের বিলুপ্তি ঘটে। বিলুপ্তপ্রাপ্ত আমিত্ববোধ তবে কোথায় সন্চালিত হয়?
মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে! মনে হচ্ছে অসুখটা মগজে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে! টের পাচ্ছি মৃদু আন্দোলনে পোকারা দল বেঁধে ঢুকে পড়ছে নিজ বাসস্থানে! এরপর ওরা ঘুমিয়ে পড়বে। ওরা ঘুমালেই নসিমন শান্ত হবে! দীর্ঘ রাতভর উলটপালট সকল ভাবনা উড়ে যাবে অসীম শূন্যতায়। কিছুই মনে থাকবে না! নসিমন ঘুম ভেঙ্গে আবারো ছুটবে জীবিকার তাগিদে শহরের পথে। গাল ভরে হেসে কথা বলবে, রান্না করবে, বাজার করবে। সন্ধ্যা হতেই জ্বানালার পাশে চায়ের কাপে ঠোট রেখে খাতা কলম টেনে নিবে। শূন্যতা বুকে বিশাল আকাশের গায়ে হিসাব মিলাবে! চাল-২ কেজি, ডাল-১কেজি,পটল-আধা কেজি, তেল-………..!
______

Add to favorites
934 views