মেঘের উপর বাড়িতে হুমায়ুন আহমেদ -
এইচ বি রিতা
Published on: জুলাই 19, 2013
যুক্তি ও আবেগ পাশাপাশি রেখে যিনি পুরো বাংলাদেশের পাঠককুলকে বিভ্রান্তিতে রাখার মত কৌশল রপ্ত করতে পেরেছিলেন, তিনি হুমায়ুন আহমেদ। হুমায়ুন আহমেদই একমাত্র লেখক যিনি তার দ্বৈতসত্তার প্রতিফলন ঘটাতে সৃষ্টি করেছেন ‘হিমু’ ও ‘মিসির আলী’র মত বহুল আলোচিত চরিত্র এবং এই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে একদিকে তিনি রুঢ় জীবনকে দেখেছেন স্বচ্ছ জলে টুপুস করে ঝড়ে পড়া পাতার সৌন্দর্য্যের মত। আবার অন্যদিকে জীবনকে দেখেছেন খুব তীক্ষ্ম ও বুদ্ধিদীপ্ত চোখে। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে এক রহস্য মানব। মিসি আলী যখন ভূত প্রসঙ্গে বলেন, “আমি ভূত বিশ্বাস করিনা, যুক্তিতে ভূত আসে না”, তখন আমরা তাই বিশ্বাস করি। এ প্রসঙ্গে যখন হিমু বলে, “অবশ্যই ভূত বিশ্বাস করি। যুক্তিই শেষ কথা নয়, জগতের অনেক কিছুই যুক্তির বাইরে” তখনো আমরা তাই বিশ্বাস করি।
মোটা ফ্রেমের ভারী চশমা পরিহিত যে লোকটি কিছুতেই বিশ্বাস করেন না অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা, যতো রহস্যময় ঘটনাই ঘটুক যুক্তি দিয়ে যিনি সমাধান খুজে নেন, সেই যুক্তিবাদী মানুষটিই ‘মিসির আলী’র অন্তরালে হুমায়ুন আহমেদ। প্রচন্ড রোদে নিউ মার্কেট এলাকায় সিগারেট হাতে হরতালের মধ্যে দাঁড়িয়ে যে যুবক অপেক্ষা করে কখন একটি বাস পুড়বে আর সেই আগুনে সে সিগারেট ধরাবে… সেই যুক্তিহীন বিস্ময়কর যুবকই ‘হিমু্’র অন্তরালে হুমায়ুন আহমেদ। বাবার বিপুল সম্পত্তির মোহ যাকে কখনো টানে না, যে সকল জটিলতা থেকে হাত গুটিয়ে শুভ্র সুন্দরের শুদ্ধতা নিয়েই বেঁচে থাকতে চান, সেই ‘শুভ্র’র অন্তরালেই হুমায়ুন আহমেদ। পাড়ার এক মাস্তানকে যেখানে সবার ঘৃণা করার কথা, যেখানে সেই মাস্তানের ফাঁশিতে খুশী না হয়ে মানুষ রাজপথ থেকে শুরু করে নিউইয়র্কের রাস্তায় পর্যন্ত মিছিলের ঢল নামায়, সেই ‘বাকের ভাই’ এর অন্তরালে যিনি, তিনিই হুমায়ুন আহমেদ। এক বাউন্ডুলেকে ভালোবাসে যেই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি সে আসবেনা জেনেও তার পছন্দের আকাশি রংয়ের শাড়ী পড়ে চোখে কাজল দিয়ে বাড়ীর ছাদে কিংবা বারান্দায় অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে, সেই ‘রুপা’র অন্তরালেই হুমায়ুন আহমেদ।
তিনি আবেগ ও যুক্তি দুটো নিয়েই খেলেছেন। তবে তিনি আধ্যাতিক কোন শক্তির অধীকারী ছিলেন কিনা, তা আমার জানা নেই। আর তা জানতে ও জানাতেই আমার আজকের লিখা।
ESP(Extra Sensory Perception) যাকে সিক্সথ সেন্সও বলা হয়, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে হুমায়ুন আহমেদ তার অসংখ্য গল্প উপন্যাসে এই ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন। হিমু চরিত্রটিতে তো অবশ্যয়ই। তবে সেগুলো ছিল শুধুই গল্প সাজাতে গল্প।
মৃত্যুর প্রায় বছরখানেক আগে স্যার লিখেছিলেন “মেঘের উপর বাড়ী” বইটি। এই বইটিতে তিনি ESP ক্ষমতার বিষয়টি এনেছেন। বইটির প্রেক্ষাপট বিচার করলে দেখা যায় যে তিনি এই অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা খুব প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন এবং বইটিতে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। বিশেষ করে ডিবি ইনস্পেক্টর খলিলের স্ত্রী “এশা”র চরিত্রে।
বইটি তিনি যখন লিখেন, তখনো তার কোলন ক্যান্সার ধরা পড়েনি। ক্যান্সার সবে তখন স্যারের দেহে বাসা বাঁধতে ফাক-ফোকর খুঁজছিল। কিংবা জায়গা করেই নিয়েছিল, হয়তো লুকিয়ে ছিল।
বইটি তিনি লিখেছেন একজন মৃত মানুষের জাবানীতে। গল্পে একজন নারীর কথা উল্লেখ্য আছে যিনি কোলন ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের প্রিয় স্যারও কোলনে ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন।
‘অন্যকথা’ শিরোনামে হুমায়ূন আহমেদ ছোট্ট একটা ভূমিকা লিখেছিলেন, যে ভূমিকাটিতে তিনি লিখেছেন,
“প্রথম আলো ঈদসংখ্যার জন্যে যখন আমি এই উপন্যাস লিখি, তখন ক্যান্সার নামক জটিল ব্যাধি আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে। এই খবরটা আমি জানিনা। ক্যান্সার সংসার পেতেছে কোলনে, সেখান থেকে রক্তের ভেতর দিয়ে সারা শরীরে ছড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার অবচেতন মন কি এই খবরটা পেয়েছে?
আমার ধারণা পেয়েছে। যে কারণে আমি উপন্যাস ফেঁদেছি একজন মৃত মানুষের জবানিতে। উপন্যাসে এক মহিলার কথা আছে, যার হয়েছে কোলন ক্যান্সার। সেই ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে। বাসা বেঁধেছে লিভারে, ফুসফুসে। হঠাৎ এইসব কেন লিখলাম? জগৎ অতি রহস্যময়!”
এই ছিল “মেঘের উপর বাড়ী” বইটি লিখা নিয়ে স্যারের বিস্ময়। এবার আসুন দেখা যাক বইয়ের ভিতরে তিনি আসলে কি কি অমীমাংসীত বিস্ময় রেখে গেছেন আমাদের জন্য!
– বইয়ের মূল চরিত্র একজন মৃত ব্যক্তি যার নাম ডঃ ইফতেখারুল ইসলাম। পেশায় তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থের এসোসিয়েট প্রফেসর। হুমায়ুন আহমেদ নিজেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। তিনিও ডঃ হুমায়ূন আহমেদ।
-বইটিতে দেখা যায়, ডঃ ইফতেখারুল ইসলাম যখন মৃত্যুশয্যায় হাসপাতালে, তখন তার শয্যাপাশে স্ত্রী রুবিনা ছাড়া আর কেউ নেই। হুমায়ূন আহমেদও যখন নিউইয়র্কের বেল্যুভুতে মৃত্যুশয্যায় ছিলেন, তখন তার পাশেও স্ত্রী শাওন ছাড়া আর কেউ ছিলনা। যদিও যদিও দুইজনের স্ত্রীদের মধ্যে স্বভাবগত ও ব্যক্তিগত চারিত্রীকগত পার্থক্য ছিল। হতেই পারে। কল্পনার সাথে বাস্তব হুবহু মিলে যায় শুধুমাত্র আল্লাহর ঐশ্বরীক ক্ষমতাপ্রাপ্তদের জন্য। মানবের জন্য নিয়ম ব্যতিক্রম।
-বইটিতে দেখা যায় ডিবির পুলিশ ইন্সপেক্টর খলিল ডঃ ইফতেখারুল ইসলামকে বিষ খাইয়ে মারার সন্দেহে তার স্ত্রী রুবীনাকে সন্দেহ করে ইনভেস্টিগেশনে নামেন।হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরও চট্টগ্রামের আইনজীবী ও লেখক এ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম শাওনকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করে একটি মামলা করেন। সেই আইনজীবীর জায়গায় আমরা পুলিশ ইন্সপেক্টর খলিলের নাম ভেবে নিতে পারি।
-ডঃ ইফতেখারের লাশ কেবিনে পড়ে থাকা অবস্থায় ওয়াকিটকি হাতে পুলিশ আসে এবং বলেন,
“আমি ডেথ রিপোর্টের কপি নিয়ে যাব। ডেডবডির সুরতহাল হবে। আমারা সাসপেক্ট করছি ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে।”
হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর পরও মিডিয়া অনলাইনে খবর ভাইরাল হয় যে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তার অগনিত ভক্ত তা বিশ্বাস করতেও শুরু করেছিল।
-বইটিতে পুলিশের জেরার মুখে ডঃ ইফতিখারের স্ত্রী রুবিনা বলেন,
“ডঃ ইফতেখার যখন অসুস্থ হন তখন তার মেয়ে পলিন এসে রুবিনার কাছে বলে মা বাসায় ভূত এসেছে। তখন রুবীনা পলিনের ঘরে যান। গিয়ে দেখেন তার স্বামী মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।” এই ঘটনার পর পরই ডঃ ইফতিখার মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান।
বাস্তবের হুমায়ুন আহমেদও আমেরিকায় অপারেশনের পর নিজ বাসার চেয়ার থেকে পড়ে যান। এবং এর পরই তিনি দ্রুত মৃত্যুর দিকে চলে যান।
-গল্পে দেখা যায, ডঃ ইফতিখারের বন্ধু রবির সাথে তার স্ত্রী রুবীনার প্রেম ছিল এবং সেই প্রেমকে পূর্ণতা দিতেই রুবীনা রবির সাহায্যে স্বামীকে খুন করেন। রবি সেকথা রিমান্ডে স্বীকার করে।
বাস্তবে দেখা যায়, হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর পর তার অনেকেই শাওনের অবহেলার কারণে হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করেন এবং সেই অবহেলার কারণ হিসাবে দেখানো হয় হুমায়ুন আহমেদের বন্ধু অন্যপ্রকাশের কর্ণদার মাজহারের সাথে শাওনের সম্পর্ক।
– গল্পে ডঃ ইপতিখারের লাশ দাফন নিয়ে জটিলতা দেখানো হয়েছে। হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর পর তার লাশ দাফন নিয়ে বিশাল ঝামেলার কথা সবার জানা।
– গল্পে ডিবি ইন্সপেক্টর খলিল তার স্ত্রী এশার জোরাজোরিতে বাধ্য হয়ে তার সন্দেহের তালিকা থেকে রুবীনাকে বাদ দেয় এবং মামলাটি সেখানেই চাপা পড়ে যায়। বাস্তবে দেখা যায় হুমায়ুন আহমেদের মায়ের অনুরোধে তার মৃত্যু নিয়ে সকল সন্দেহ ও জটিলতা থেমে যায়।
মৃত্যুর এক বছর কি তারো কম সময় আগে লিখা “মেঘের উপর বাড়ী” বইটির ভিতরের খন্ডচিত্র ও ঘটনাবলী এবং হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যু- এতটা যোগসূত্র তৈরী করে কিভাবে? তবে কি তিনি ESP ক্ষমতার বলে পরবর্তী দিনগুলো ধারণা করে নিয়েছেন? ESP ক্ষমতা তিনি অতীতে বহু গল্প উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেই ক্ষমতা ব্যবহারে “মেয়ের উপর বাড়ী” গল্পটির মত কোন বিষয়বস্তু, চরিত্র, স্থান, কাল বা ঘটনাবলী নিয়ে লিখেননি। তবে কি তিনি অলৌকিক-ঐশ্বরীক কোন ক্ষমতা দ্বারা নিজের মৃত্যু এবং তার পরবর্তী সময়ের বিক্ষিপ্ত ঘটনাসমূহ জেনে গিয়েছিলেন?
ওইজা বোর্ডের নাম নিশ্চয় শুনেছেন। ওইজা বোর্ডের মত আরেকটি গেইম আছে, ‘Table Tilting’ বা টেবিল ঝাঁকুনি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে জীবিতরা মৃত মানুষদের আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এই গেইমে কয়েকজন একটা টেবিলের উপর দুই হাত রেখে বসবে এবং গভীর ধ্যানের মাধ্যমে তারা একজন মৃত ব্যক্তির আত্মাকে আসতে আমন্ত্রণ জানাবে। সেই মৃত আত্মা আসামাত্র টেবিল নিজে থেকেই ভয়ংকরভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠবে। কখনোবা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এটা কিছু সময়ের জন্যে এক পায়ের উপর ভর করে বাকিটা মেঝে হতে শূণ্যে উঠে যাবে। পরিস্থিতি বেশি বেগতিক হলে এটা সারা রুমে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতে পারে। ১৮৫৩ তে মাইকেল ফ্যারাডে তার গবেষণামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন- টেবিলের এই নিয়ন্ত্রণহীন নড়াচড়ার মূল কারণ হচ্ছে আসলে ‘ইডিওমোটর প্রভাব’। এটা হচ্ছে সেই অবস্থা যখন ‘অটোসাজেশান’ ক্ষমতার প্রভাবে আমাদের অবচেতন মন বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ গ্রহণ করতে শুরু করে এবং সেই সাজেশান অনুযায়ী অবচেতন মন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নড়াচড়া করতে নির্দেশ দেয়। এই নড়াচড়া অবচেতন মনের নির্দেশে হয় বিধায় এটা পুরোপুরি অনৈচ্ছিক।
বিস্ময় মানব সৃষ্টির এক প্রকৃতিগত স্বভাব। মানুষ বিস্মিত হয়, অমীমাংসিত রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হতে হতে মানুষ বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে। জানা-অজানা এই পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সকল রহস্যের কারণ বা উত্তর উন্মোচন সম্ভব হয়না। কিছু অমীমাংসিত রহস্য এভাবেই থেকে যায়। অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত বিশেষ কোন ক্ষমতা স্যারের ছিল কিনা, তা পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম। বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে বেঁচে থাকলে, মৃতুর ঠিক বছর আগে কেন স্যার ‘মেঘের উপর বাড়ী’ নামক এমন একটি বই লিখলেন যার সাথে তার মৃত্যু ও পরবর্তী ঘটনাসমূহের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়, এই রহস্যের নিশ্চয় কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখা বের করতেন।