সালেহার নীতিবোধ -
এইচ বি রিতা
Published on: আগস্ট 29, 2016
খুপটিমত নিজের ঘরটিতে ঢুকে পুটলাটা হাতে নিল সালেহা। তড়িঘড়ি করে আরেকবার দেখে নিল স্বর্নের দুল জোড়া ঠিকঠাক আছে কিনা। নাহ! আছে! মনটা খুশীতে ভরে উঠলো সালেহার!
ছোট বোনটার বিয়ে আটকে আছে, এক জোড়া দুল চাই। জামাইকে একটা সাইকেল দিতে হবে। মাটির ব্যাংকটা ভাঙলে হাজার পাঁচেক বের হবে। একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। দুল জোড়া গত রাতেই চুরি করেছে সালেহা।মেম সাহেবের এত্ত এত্ত গহনা, এক জোড়া গেলে কি আর তেমন ক্ষতি হবে!
সালেহারা তিন বোন। মা আছেন, তিনিও ছুটা কাজ করেন অন্যের বাড়ীতে। সালেহা বড়। মেঝুটাকে কোন মতে এসএসসি পাস করিয়েছে, ছোটটা বধীর, ঘরেই থাকে।
বাবা বেঁচে থাকতে কলা গাছের গেইট সাজিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া সালেহার বিয়ে হয় । স্বামী একটা মুদির দোকানের মালিক। বিয়ের দুই বছর পরই স্বামী মারা যায় দূরারোগ্য এক ব্যাধীতে। সন্তান না থাকায় শশুড়ালয় থেকে বিতারিত হতে হয় তাকে। এদিকে বাবাও চলে যান বিয়ের ছয় মাস পরই। দুই বোন নিয়ে সালেহার মা তখন বাতাস চিবিয়ে পেট ভরেন। রাত হলে কখনো সখনো ক’টা ভাত মুখে গুঁজে দেন লবন দিয়ে। সালেহার ফিরে আসা ছিল তখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতন।
একবার মায়ের ভীষণ অসুখ হলো। ডাক্তার বলল আলসার, শীঘ্রই অপারেশন লাগবে। হাড়িতে ভাত ছিলনা, সালেহার কানে ছিল শেষ সম্বল দুটি বালি। সেটা বিক্রি করেই অপারেশন হলো মাযের। তারপর আরো কত বার মায়ের পেটে ব্যাথা হলো! ডাক্তার দেখাতে পারেনি! মেঝু বোনটা তখনো স্কুলে যায়।
একদিন সন্ধ্যায় পুকুর ঘাটে সালেহাকে বুকে চেপে ধরলো মাতব্বরের ছেলে মতিন। কোমরের ভাঁজে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল, তোকে আমার বড় ভাললাগে! তোকে বিয়ে করবো রে সালেহা! সেই থেকে প্রতি রাতে সালেহার ফুটন্ত গোলাপের সৌরভ নিতে লাগলো মতিন। সালেহা ভাবলো, পয়সাওয়ালা লোক! বিয়ের পর তার মা বোনকে আর না খেয়ে থাকতে হবেনা!
একদিন মধু খেয়ে ভ্রমর উড়ে গেল চিরাচরিত নিয়মে। কেউ জানলো না কতটা খেয়ে গেল সে! শুধু সালেহা জানলো! আর তার মা, আঁচলে গিট বেঁধে আড়াল করে রাখলেন মেয়ের শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়িগুলো!
একদিন, পথে নামলো সালেহা জীবিকার তাগিদে। যেখানেই যায়, জীবিকার বদলে যৌবন কেড়ে নিতে চায় ওরা! কি ভয়ংকর! চারদিকে কেবল বুভুক্ষের ত্রাস! মানুষের ভিতর এত ভোজনেচ্ছা, এত দাহ,কেউ তো আগে বলেনি! এই শরীর এত শক্তিশালী যে পৃথিবীর সকল পশুত্বকে নুপুংশুক করে ছাড়তে পারে?
বহু ঘুরপাক সেরে অবশেষে সালেহা কাজ নেয় শহরের বিত্তশালী এক পরিবারে। দিনভর নিরলস কাজের বদলে থাকতে দেয়া হয় একটি খুপটি ঘরে, তিন বেলা বেঁচে যাওয়া খাবার আর মাস গেলে নগদ ১০০০ টাকা! কখনো হাত থেকে বাটি-বাসন পড়ে গেলে বেতন থেকে কাটিয়ে নেয়া হয়। আর সুযোগ পেলে সাহেব তো বুক ছুঁয়ে দিতে কার্পন্য করেননা!
সালেহার মন আজ ভীষণ খুশী। বোনের জন্য এক জোড়া কানের দুল সরাতে পেরেছে! খুচরা কিছু টাকাও এদিক-ওদিক করেছে! সব মিলিয়ে একটা সাইকেল হয়ে যাবে।
বোনটার বিয়ে হবে। ঘর হবে। মাকে আর মানুষের বাড়ীতে ছুটা কাজ করতে হবেনা। এবার পেটের চিকিৎসা হবে। ছোটবোনটার জন্য একটা সেলাই মেশিন কিনে দিবে!
সেদিন মুখ ভার করে সালেহার মা বলছিল, সালেহা! মেঝুর হবু শাশুড়ী বলছিল তুই যেন……! সালেহা বুঝে নিয়েছিল মা কি বলতে চায়।মাকে আশ্বস্ত করতে সালেহা শুধু হেসেছিল। বলেছিল, মা! আমি আড়ালেই থাকবো! চিন্তা করোনা!
সালেহা জানে, জীবন বড় কঠোর, নির্দয়! এ জীবন শুধু কেড়ে নেয়, দিতে তার বড় আপত্তি। তাই সালেহা জোর করে সব নেয়। কানের দুল, টাকা, সুন্দর উড়না, ফ্রিজে প্যাক করে রাখা মাছ-মাসের পুটলা….সব! প্রয়োজনের কাছে নীতিবোধ বেমানান। পেটে ক্ষুধা নিয়ে প্রেম হয়না, সখ্যতা হয়না, যা হয় তা চুক্তি। যা প্রাপ্য তা থেকে বন্চিত হলে আদায় করতে হয়। কেড়ে নিতে হয়, যেমন নেয় জীবন; জীবনের কাছ থেকে। যে চোখ রাত হতেই বর্ষার আঙ্গিনার মত ভিজে উঠে, সে চোখ দিনের আলোয় ধূর্ত শেয়ালের মত লুটপাটের সুযোগ খুঁজে! পেঁয়াজ, তরকারী, টাকা, জিনিস, গহনা, মাছ-মাংস পুটলা বাঁধে! সালেহা বিচলিত হয়না! সকল হিসাব মগজের ভিতর টুকে রাখে!

Add to favorites
647 views